আলুতে ক্ষতিকর মাত্রায় ভারী ধাতুর উপস্থিতি
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় আলু ও আলু উৎপাদনের মাটিতে ক্ষতিকর মাত্রায় নিকেল ও ক্যাডমিয়ামের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা—যা ক্যান্সারসহ সম্ভাব্য অন্যান্য ঝুঁকি নিয়ে জনস্বাস্থ্য উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, জমিতে শিল্পবর্জ্য, সেচের পানি, সার ও কীটনাশক ইত্যাদির মাধ্যমে আলুর মধ্যে এসব ক্ষতিকর ভারী ধাতু মিশতে পারে।
গবেষণা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি ডাচ একাডেমিক প্রকাশক 'এলসেভিয়ার'-এ প্রকাশিত হয়েছে।
আলুতে এসব ক্ষতিকর ভারী ধাতুর উপতিস্থিতির ফলে মানুষের শরীরে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগ-বালাই তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
গবেষকরা বলছেন, এসব ভারী ধাতু খাবারের সঙ্গে মিশে মানুষের শরীরের হজমশক্তি বিঘ্নিত করে এবং রক্তে মিশে কিডনি ও লিভার নষ্ট করে।
গবেষণায় প্রতি গ্রাম আলুতে সর্বোচ্চ ২.৯৩৮ মাইক্রোগ্রাম নিকেল ও ০.০১৩৯ মাইক্রোগ্রাম ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। যদিও এ দুটি ধাতু সামান্য পরিমাণ গ্রহণও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা, ঈশ্বরগঞ্জ, ফুলপুর ও গফরগাঁওয়ের মোট ২৪টি এলাকায় কৃষকের খেত থেকে আলু ও আলু উৎপাদনের মাটির নমুনা সংগ্রহ করেন গবেষকরা। এসব নমুনায় ক্যাডমিয়াম, নিকেল, লেড, ক্রোমিয়াম, কপার, জিংক, আয়রন, কোবাল্ট ও ম্যাঙ্গানিজ—এ নয়টি ধাতুর মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।
আলুর মধ্যে লেড, ক্রোমিয়াম ও কোবাল্টের উপস্থিতি পাননি বিজ্ঞানীরা।
ধানের পরই দেশের সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত ফসল আলু। প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের নিয়মিত খাবার তালিকায় আলু থাকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় জরিপ ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন একজন মানুষ গড়ে ৬৯.৭ গ্রাম আলু খেয়ে থাকেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদিন মানুষকে ০.০৯১৩ মিলিগ্রাম নিকেল ও ০.০০০৫ মিলিগ্রাম ক্যাডমিয়াম শুধু আলু থেকে গ্রহণ করতে হচ্ছে।
আলু উৎপাদনে ব্যবহৃত মাটির নমুনাগুলোর মধ্যে গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি গ্রাম মাটিতে ৪.৬৯–১৯.৯২ মাইক্রোগ্রাম লেড, ২১.২৭–৯৯.৮৪ মাইক্রোগ্রাম নিকেল, ০.০৪–০.৩২ মাইক্রোগ্রাম ক্যাডমিয়াম, ২.০১–১০.৬০ মাইক্রোগ্রাম কোবাল্ট, ৪৪.৭৯–৮৮.৬১ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম, ১১.৯৪–৩০.০৩ মাইক্রোগ্রাম কপার, ৫৩.২০–৭০.৪২ মাইক্রোগ্রাম জিংক, ১৪৫৪১–৪১,১৫৩ মাইক্রোগ্রাম আয়রন ও ৫৭২–৭৮২.২ মাইক্রোগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত লেড, নিকেল ও ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি রয়েছে।
গবেষণা দলের মুখপাত্র, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাকির হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সাধারণত জমিতে শিল্পবর্জ্যের মাধ্যমে ফসলে ভারী ধাতু মিশতে পারে। এ কারণে যে স্থানে শিল্পকারখানা নেই, গবেষণার জন্য তারা ওইসব জায়গাকে বাছাই করেছেন।
তিনি বলেন, 'জমি ও আলুতে যে পরিমাণ নিকেল ও ক্যাডমিয়ামের উপস্থিতি পেয়েছি, তা অবশ্যই ভয়ের কারণ। সেচে ব্যবহৃত ভূগর্ভস্থ পানি বা নদ-নদীর পানি, সার ও কীটনাশকের মাধ্যমে এসব ভারী ধাতু ফসলে আসতে পারে। পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে ও নিরাপদ খাদ্য তুলে দিতে বিষয়টি নিয়ে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে ভাবতে হবে।'
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেনিন চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, ভারী ধাতু মানুষের শরীরে ক্যান্সার তৈরিতে কাজ করে। এসব ভারী ধাতু খাবারের সঙ্গে মিশে মানুষের শরীরের হজমশক্তি বিঘ্নিত করে এবং রক্তে মিশে কিডনি ও লিভার নষ্ট করে। এর ফলে নারী-পুরুষের বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়।
তিনি আরও বলেন, 'প্রতি বছর প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রায় ১০ শতাংশ কিডনি রোগে ভুগছে। বন্ধ্যাত্বের হার দিন দিন বাড়ছে। এসবের পেছনে শস্যে বা মাটিতে যে ভারী ধাতু রয়েছে, সেটির ভূমিকা আছে।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, 'আলুতে ভারী ধাতু নিয়ে গবেষণাটি সম্পর্কে জানি না। আমাদের কৃষকেরা সার ও কীটনাশক ব্যবহারে সচেতন নন। আমরা সবসময় সুষম সার ও কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহ দিই।'
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৯ লাখ টন।