ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ হাজার হাজার অভিবাসীর পরিচয় কোনো দিনই কেন শনাক্ত হয় না!
ভূমধ্যসাগরের তটে এপ্রিল খুব সুন্দর মাস। কিন্তু মেরন এস্তেফানোসের মতো আরও কয়েকজনের জন্য এ মাসটা সমূহ বিপদের ইঙ্গিত।
এস্তেফানোস এবং তার মতো কিছু মানুষ এ সাগরের অভিবাসী প্যাসেজগুলোর দিকে নজর রাখেন। উগান্ডায় কাজ করেন ইরিত্রিয়ার নাগরিক এস্তেফানোস। তার মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে, 'এ বছর কত মানুষের সলিলসমাধি হবে? কত মায়ের বুক খালি হবে?'
গত এক দশকে ভূমধ্যসাগর ভূরিভূরি প্রাণহানির মঞ্চ হয়ে উঠেছে। এ সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অন্তত ২০ লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার এখনো নিখোঁজ, ধারণা করা হচ্ছে তারা চিরতরে হারিয়ে গেছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অভ দ্য রেড ক্রস-এর অনুমান মোট জানা মৃত্যুর মধ্যে কেবল ১৩ শতাংশের মতো লাশ উদ্ধার করা গেছে। এদের বড় একটা অংশের পরিচয় কখনোই জানা যায় না। নিখোঁজ কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর ব্যাপারে পরিবারের নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা লটারি জেতার মতো ক্ষীণ বলে মন্তব্য করেন একজন মানবাধিকারকর্মী।
ইউনিভার্সিটি অভ মিলান-এর ফরেনসিক প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক ক্রিস্তিনা ক্যাতানিও'র লাবানফ ল্যাবরেটরি ইতালি কর্তৃপক্ষের উদ্ধার করা অভিবাসীদের লাশ শনাক্তে কাজ করে। তবে এ কাজে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো তহবিল পায় না ল্যাবটি।
স্পেনের একটি কেন্দ্রীয় ফরেনসিক ডেটাবেজ থাকলেও সেখানে কেবল নাম ব্যবহার করে অনুসন্ধান করা যায়। ইতালি ও গ্রিসে নিখোঁজ অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন স্থানীয় দপ্তর ও এলাকার মধ্যে সমন্বয়ের পরিমাণ খুব কম। ২০১৮ সালে ইতালি, মাল্টা, গ্রিস ও সাইপ্রাস ইউরোপীয় কমিশনের সঙ্গে ফরেনসিক তথ্য বিনিময়ের একটি সমঝোতায় পৌঁছালেও তা এখনো কার্যকর হয়নি।
এসব ঘাটতির মধ্যেই ক্যাতানিওয়ের মতো মানুষেরা তাদের কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। 'সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো আত্মীয়স্বজনের অনুসন্ধান করা। তবে সেটা করা একেবারে অসম্ভব নয়,' তিনি বলেন।
অন্যদিকে নিখোঁজ অভিবাসীদের অনুসন্ধান কাজে রত সবচেয়ে পরিচিত মানুষদের একজন এস্তেফানোস। নিখোঁজ মানুষদের আত্মীয়স্বজন তাকে বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করেন। নিখোঁজ ব্যক্তি কোন স্থান থেকে কবে কোন নৌকায় উঠেছিলেন বা ওই ব্যক্তির শরীরে বিশেষ কোনো চিহ্ন আছে কি না, এসব তথ্যই পাওয়া যায় আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে।
এরপর এস্তেফানোস ওই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের গল্পগুলো ফেসবুকে এবং নিজের সাপ্তাহিক রেডিও শোতে শেয়ার করেন।
মাঝেমধ্যে কোনো বেঁচে যাওয়া যাত্রী এস্তেফানোসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অনেক সময় দালালেরা ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রী-তালিকা তাকে পাঠায়।
প্রায়ই নৌকা সমুদ্রের এত গভীরে ডুবে যে, সেগুলোর চিহ্নমাত্রও আর কখনো পাওয়া যায় না। আবার কখনো মৃতদেহ বিভিন্ন উপকূলে ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলোর গায়ে কোনো পরিচয়পত্র না থাকলে উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষ খুব বেশি অনুসন্ধান চালায় না।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন অভিবাসন বন্ধের ওপর বেশি জোর দিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যদি বড় কোনো নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে এবং তা গণমাধ্যমের তীক্ষ্ণ নজরে পড়ে, কেবল তখনই নিহতদের পরিচয় শনাক্তে সমন্বিত ব্যবস্থা নেয় সংস্থাটি।
ক্যাতানিও বলেন, 'মানুষ ইচ্ছে করেই ও সচেতনভাবেই সমস্যাটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।'
তিউনিসিয়ার দক্ষিণ উপকূলে জেলেদের জালে অনেকসময় অভিবাসীদের মৃতদেহ আটকা পড়ে। সেখানকার সমুদ্রসৈকতগুলোতে প্রায়ই লাশ পাওয়া যায়।
ইউনিভার্সিটি অভ আমস্টারডাম-এর নৃতত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ উতেফ আমাদ শারেক ২০১৬ সালে জানতে পারেন, লিবিয়ার সীমান্ত থেকে মাইল পঞ্চাশেক দূরে তার জন্মস্থান জারজিসে প্রায়ই অভিবাসীদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমানে তিনি বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণা করছেন। ইউরোপিয়ান রিসার্চ কাউন্সিলের অনুদানে একটি প্রকল্পের মূল অনুসন্ধানকারী তিনি। তার গবেষণার প্রশ্ন: এ লাশগুলো সেখানে গিয়ে পৌঁছাল কীভাবে?
'শুরুর বছরগুলোতে মানুষ এসব মৃতদেহ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাত না,' তিনি বলেন। তখন তিউনিসিয়ার অভিবাসীরা আরও শক্তপোক্ত নৌকায় চড়ে, তুলনামূলক নিরাপদ পথে অভিবাসন গন্তব্যে যাত্রা করত। ওই সময় নৌকাডুবির সংখ্যাও ছিল কম।
কিন্তু পরিস্থিতির বদল ঘটে ২০১৯ সালে। ওই বছরের জুলাই মাসে জারজিসের তটে ৮৭টি মৃতদেহ ভেসে আসে। তখন অন্য একটি গবেষণার কাজে শারেক সেখানে ছিলেন।
শহর কর্তৃপক্ষ লাশগুলোকে গেবস নামক আরেকটি শহরে নিয়ে যায়। সেখানকার একটি হাসপাতালে লাশগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়।
ওই হাসপাতালে সাধারণত মৃতদেহের পোশাক বা সেগুলোর সঙ্গে থাকা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র দেখে সেগুলোর শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়।
তাই কোনো মৃতদেহ তিউনিসিয়ার নাগরিকের হলে এবং ওই ব্যক্তির পরিবার তাকে সক্রিয়ভাবে অনুসন্ধান করলে সেগুলোর পরিচয় শনাক্ত করা তুলনামূলক সহজ হয় বলে জানান শারেক। একেবারে অপরিচিত কোনো মৃতদেহের পরিচয় শনাক্তের কাজটা অবশ্য আরও জটিল।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের অন্য দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের ডিএনএ নমুনা যাচাইয়ের জন্য আন্তর্জাতিক ডেটাবেজ দরকার। আর তার জন্য ওসব আত্মীয়স্বজনকে স্থানীয়ভাবে নিজেদের জৈব স্যাম্পল সরবারহ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ কাজে সবচেয়ে বড় বাধা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
'কিছু একটা বদল দরকার। এটা কেবল জাতীয় পর্যায়ে করা সম্ভব নয়। সমস্যার প্রকৃতির কারণেই এটিকে আন্তর্জাতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। আপনি কখনোই বলতে পারবেন না কোন লাশটা কখন কোথায় ভেসে উঠবে,' শারেক বলেন।
তিউনিসিয়ার উপকূলে ভেসে আসা অনেক অভিবাসীর মৃতদেহের দাফন করেন জারজিসের অধিকারকর্মী ও জেলে চ্যামসেডিন মারজগ। তার 'অজ্ঞাতপরিচয়দের গোরস্থান' শত শত অভিবাসীর শেষ বিশ্রামের ঠিকানা হয়ে উঠেছে।
'এ গ্রীষ্মে অবস্থা করুণ হয়েছিল,' মারজগ বলেন। তার গোরস্তানে এখন আর জায়গা নেই।