ভুয়া কাগজপত্রের অভিযোগের মধ্যে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করল মালদ্বীপ
বাংলাদেশ থেকে স্বল্প-দক্ষ কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের একমাত্র শ্রম অভিবাসন গন্তব্য মালদ্বীপ।
বাংলাদেশি মধ্যস্বত্বভোগী ও এজেন্সিগুলোর যোগসাজশে মালদ্বীপের কিছু কোম্পানি ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে অবৈধভাবে নিয়োগ দিচ্ছে—এমন অভিযোগ আসার পর এ পদক্ষেপ নিল দেশটি।
মালদ্বীপের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ফাথিমাথ রিফাথ নিশ্চিত করেছেন, এক মাস আগে নিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। মালদ্বীপের সংবাদমাধ্যম সান অনলাইন জানিয়েছে, কোম্পানিগুলোর ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে কর্মী নিয়োগ দেওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসার পর এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।
মালদ্বীপে বাংলাদেশ হাইকমিশন অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছে। তারা বলছে, মালদ্বীপে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কোটা শেষ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে আরও কিছু কারণ মিলিয়ে দেশটি কর্মী নেওয়া বন্ধ করেছে।
অবৈধ অভিবাসন মালদ্বীপের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যার সমাধানে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় 'কুরাঙ্গি' নামে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। এ অভিযানে ৭০০ জনের বেশি অভিবাসীর কাছ থেকে বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
মালদ্বীপ যে এবারই প্রথম বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ করেছে, তা নয়। আগের প্রশাসন ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি কর্মী নিওগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, যা বর্তমান সরকার ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তুলে নেয়।
মালদ্বীপে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (শ্রম কল্যাণ) মো. সোহেল পারভেজ টিবিএসকে বলেন, মালদ্বীপের আগের সরকার নিয়ম করে দিয়েছিল যে দেশটিতে ১ লাখের বেশি বিদেশি কর্মী যেতে পারেব না।
নতুন সরকার আসার পর কর্মীর ঘাটতি পোষানোর জন্য এ বিধিনিষেধ তুলে নেয়। তবে এখন তাদের কোটা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় তারা আপাতত কর্মী নেওয়া স্থগিত করেছে।
ভুয়া কাগজপত্রে কর্মী যাওয়ার কারণে শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়েছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে সোহেল পারভেজ বলেন, সামান্য কিছু কোম্পানি চাহিদা দেখিয়ে কর্মী এনে তাদেরকে কাজ না দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। সম্ভবত অতিরিক্ত টাকা আদায় করার জন্য তারা কাজটি করে থাকতে পারে।
এ কাজে একটি বাংলাদেশি সিন্ডিকেট জড়িত ছিল এবং মালদ্বীপ কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর বিষয়ে তদন্ত করছে বলে জানান তিনি।
মালদ্বীপ কর্তৃপক্ষের ভিসা যাচাই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে সোহেল পারভেজ বলেন, 'এসব লোক প্রপার ভিসা নিয়ে এলেও তারা কাজ পাননি। মালদ্বীপ কর্তৃপক্ষ যাচাই না করে কেন এসব ভিসা ইস্যু করল সেটা একটি প্রশ্ন।'
অনেক বাংলাদেশি কর্মীও তাদের কোম্পানির কাছ থেকে পালিয়ে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যখনই তারা নিজের কোম্পানি ছেড়ে দেন, তারা আনডকুমেন্টেড হয়ে পড়ে।'
তবে মালদ্বীপের নতুন সরকার কোটা সিস্টেম উঠিয়ে দিতে পারে জানিয়ে সোহেল পারভেজ বলেন, 'তখন আশা করি এই স্থগিতাদেশ থাকবে না।'
ডিসেম্বরে মালদ্বীপের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলি ইহুসান বলেছিলেন, বাংলাদেশি কর্মীদের ১ লাখ ৩৯ হাজার ২২০টি সক্রিয় ওয়ার্ক পারমিট আছে। তবে তাদের মধ্যে মাত্র ৩৯ হাজার ৪ জন ধারাবাহিকভাবে প্রয়োজনীয় ফি দিচ্ছেন।
ডিসেম্বর পর্যন্ত মালদ্বীপে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা ছিল ৯০ হাজার ৬৪২ জন, যা কর্মসংস্থান আইন দ্বারা একক-উৎস বাজারের জন্য নির্ধারিত ১ লাখের সীমার নিচে।
মালেভিত্তিক বাংলাদেশি সাংবাদিক মো. ওমর ফারুক খন্দকার ফোনে টিবিএসকে বলেন, 'কিছু বাংলাদেশি অন্য দেশে চলে গেছেন। এতে অ্যাক্টিভ পারমিট থাকা সব কর্মীকে ট্র্যাক করা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। এছাড়া অনেকেই এখনও আনডকুমেন্টেড অবস্থায় থাকছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'ফ্রি ভিসা' সিস্টেমের ফায়দা নিয়ে আরও বেশিসংখ্যক কর্মী আনা লাগানো হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগ দিয়ে টাকা আদায়ের জন্য নিয়োগকারী এবং বাংলাদেশী এজেন্সি ও মধ্যস্বত্বভোগী উভয়ের মধ্যেই সিন্ডিকেট কাজ করছে।
মালদ্বীপের অর্থনীতি পর্যটনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। গত বছর দেশটিতে ১.৮ মিলিয়ন বিদেশী পর্যটক গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশি কর্মীরা মূলত পর্যটন ও হসপিটালিটি খাতে—যেমন হোটেল কর্মী, রেস্তোরাঁর ওয়েটার ও শেফ—কাজ করেন। চিকিৎসকের মতো কিছু পেশাজীবীও দেশটিতে কাজ করেন।
সম্প্রতি মালদ্বীপে যাওয়া কর্মীদের অভিবাসন বাবদ প্রায় তিন থেকে চার লাখ টাকা দিতে হয়েছে। তবে হোটেল ও রেস্তোরাঁয় বৈধভাবে কর্মরতরা মাসিক ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন।
হবিগঞ্জের বেলাল হোসেন তার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, 'ছয় বছর আগে গেস্ট রিসিভার হিসেবে ২০০ ডলার বেতনে কাজ শুরু করেছিলাম। এখন ওয়েটার হিসেবে মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার আয় করি।'
বাংলাদেশি কর্মীরা চলতি অর্থবছরে (জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) ৩১.৬৯ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট-এর (রামরু) গত বছরের একটি সমীক্ষা অনুসারে, মালদ্বীপে মাত্র ৫২ শতাংশ বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মী প্রতিশ্রুত মজুরি পান। তাদের গড় মাসিক আয় ৩৫ হাজার ১৪৭ টাকা।
সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, মালদ্বীপে নথিভুক্ত বাংলাদেশি কর্মীরা মাসে গড়ে ৩৭ হাজার ৬৬ টাকা আয় করেন, আর নথিভুক্ত নন এমন বাংলাদেশি কর্মীরা গড়ে ২৫ হাজার ৬৫০ টাকা আয় করেন।
সমীক্ষায় আরও উঠে এসেছে, মালদ্বীপে ৩৩ শতাংশ বাংলাদেশি হোটেল ও রিসর্টে, ২৫ শতাংশ নির্মাণে, ৭ শতাংশ দিনমজুর হিসাবে, এবং ২ শতাংশ করে গৃহকর্মী হিসেবে ও মৎস্য খাতে কাজ করেন। বাকি ৩১ শতাংশ বাংলাদেশি অন্যান্য বিভিন্ন খাতে কাজ করেন।