৪৮ বছরেও হয়নি গ্রাম পুলিশের জাতীয়করণ
১৯৭৬ সালে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে প্রতিটি জেলায় গ্রাম পুলিশ জাতীয়করণের জন্য পরিপত্র জারি করা হলেও বিগত ৪৮ বছরে সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৭৬ সালের পর ২০০৮ সালে সরকার আবারো এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার এবং ২০১১ সালে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এরপরেও আলোর মুখ দেখেনি গ্রাম পুলিশ জাতীয়করণের উদ্যোগ।
এতে গ্রাম পুলিশকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে স্থানীয় সরকার। আবার এই বেতন-ভাতায় দুর্ভোগের জীবন পোহাতে হচ্ছে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের।
২০১৫ সালে গ্রাম পুলিশ বাহিনীর গঠন, প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও চাকরির শর্তাবলী সম্পর্কিত বিধিমালা নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। ২০১৭ সালে এতে আংশিক সংশোধন সাধিত হয়।
এই বিধিমালা অনুসারে, গ্রাম পুলিশ সদস্যরা বেতনের অর্ধেক-অর্ধেক অর্থ জেলা প্রশাসক ও চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে পেয়ে থাকেন। যেটি উপজেলা নির্বাহী অফিসার সমন্বয় সাধন করে। এছাড়া থানা হাজিরা হিসেবে মাসে প্রত্যেকে ১ হাজার ২০০ টাকা করে যাতায়াত ভাতা পান।
জানা যায়, সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর গ্রাম পুলিশের দফাদারদের বেতন ৩ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা এবং মহল্লাদারদের বেতন ৭,০০০ টাকা করা হয়।
তবে দফাদার ও মহল্লাদাররা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে তাদের বেতনের অংশ নিয়মিত পাচ্ছেন না বলে গ্রাম পুলিশের সদস্যরা জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ৪নং দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের দফাদার লুৎফা বেগম বলেন, "বেতনের সরকারি অংশটুকু নিয়মিত হলেও বকেয়া থাকে ইউনিয়ন পরিষদের ভাগ। কারণ এখানে নিয়মানুসারে সমন্বয় করা হয় না। আবার আমাদের থানা হাজিরা নিয়মিত না হওয়ায় যাতায়াত ভাড়া থেকে বঞ্চিত হয়। অর্থাভাবে আমার জীবনে কলহ লেগেই আছে।"
আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০১১ সালের ২ জুন, সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয় ইউনিয়ন পরিষদের তিনজন সরকারি কর্মচারী থাকবেন। সচিব, দফাদার ও মহল্লাদার। তারা প্রত্যেকেই জাতীয় বেতন-স্কেল অনুসারে বেতন-ভাতা ও পেনশন প্রাপ্ত হবেন। তখন থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সচিব জাতীয় বেতন স্কেলে সুবিধা পেলেও বঞ্চিত হয়ে আসছেন দফাদার ও মহল্লাদাররা।"
এদিকে, সার্বিক বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের ইউনিয়ন পরিষদ অধিশাখার যুগ্মসচিব মোহাম্মদ ফজলে আজিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
বর্তমানে প্রতিটি ইউনিয়নে ৯ জন মহল্লাদার ও ১ জন দফাদারের সমন্বয়ে ১০ সদস্যের গ্রাম পুলিশ বাহিনী কর্মরত থাকে। বাংলাদেশের ৪ হাজার ৫৭৮টি ইউনিয়নের ৪৫ হাজার ৮৭০ গ্রাম পুলিশের বেতন দেওয়া হয় দুইভাগে।
গ্রাম পুলিশের প্রশিক্ষণ হ্যান্ডবুক অনুসারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও গ্রাম আদালতের নোটিশ জারি, জমি জরিপ কাজ, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, স্যানিটেশন কার্যক্রম, পরিবেশ রক্ষা, বাল্যবিবাহ ও যৌতুক নিরোধ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধসহ ৩২টি দপ্তরের প্রায় ৭০ প্রকারের দায়িত্ব পালম করে থাকে গ্রাম পুলিশ।
জাতীয়করণে সরকারের পদক্ষেপ
২০০৮ সালের ৫ আগস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় বরাবর একটি তাগিদপত্রে উল্লেখ করা হয়, 'দ্যা ভিলেজ পুলিশ রুলস, ১৯৬৮ এবং বিভিন্ন সময়ে জারিকৃত সার্কুলার মোতাবেক গ্রাম পুলিশ পরিচালিত হয়। সংস্থাপন ও অর্থ বিভাগের ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি ৯ জুলাই একটি সভা আহবান করে। সভায় গ্রাম পুলিশদেরকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সম স্কেল প্রদানের দাবি অত্যন্ত মানবিক ও বিবেচনাযোগ্য হওয়ায় অর্থ বিভাগে প্রস্তাব প্রেরণে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।'
পরে, ২০১০, ১১ ও ১২ সালে কয়েকবার স্থানীয় সরকার বিভাগ অর্থ বিভাগকে চিঠি প্রদান করলেও বেতন-কাঠামোর জাতীয়করণের বিষয়ে কোন সুরাহা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্রিটিশ সরকার গ্রাম চৌকিদারি আইন, ১৮৭০ প্রণয়নের মাধ্যমে গ্রাম পুলিশকে আইনি স্বীকৃতি দেয়। এরপর পাকিস্তান আমলে মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ ১৯৫৯-এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নাম পরিবর্তন করে দফাদার ও মহল্লাদার করা হয়। তখন তাদের বেতন ছিল ৫০ টাকা; যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের সমান।
স্বাধীন বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর মাধ্যমে তাদের নাম গ্রাম পুলিশ রাখা হয় এবং গ্রাম প্রতিরক্ষা বিষয়ক কার্যাবলী নির্দিষ্ট করা হয়।
সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় তিন বছর
২০১৭ সালে ঢাকার ধামরাই উপজেলার কুশুরা ইউনিয়নের দফাদার লাল মিয়াসহ ৩৫৫ জন গ্রাম পুলিশ রিট করেন। আদালতের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে শেষে সে বছরের ৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন।
রুলে ২০০৮ সালের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের চতুর্থ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ১৫ ও ১৭ ডিসেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট।
রায়ে বলা হয়, ২০১১ সালের ২ জুন থেকে গ্রাম পুলিশের মহল্লাদারদের জাতীয় বেতন স্কেলের ২০তম গ্রেডে এবং দফাদারদের ১৯তম গ্রেডে বেতন–ভাতাদি প্রদান করতে হবে রাষ্ট্রকে। হাইকোর্ট রায়টি বাস্তবায়ন করে ২০২০ সালের মার্চে রাষ্ট্রপক্ষকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
তবে রাষ্ট্রপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেন। একইসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল দায়ের করার জন্য নির্দেশ দেন।
রায়টির পূর্ণাঙ্গ কপি ২০২০ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ হলে রাষ্ট্রপক্ষ ১৫ অক্টোবর লিভ টু আপিল দায়ের করে। পরে চেম্বার জজ আদালত মামলাটি ২০২১ সালের ২৬ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন। এরপর থেকে আদালতের কার্যতালিকায় থাকলেও বিগত তিন বছর থেকে বিষয়টি অমীমাংসিত আছে।
আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লব বলেন, ২০১১ সালের প্রজ্ঞাপনের পর ২০১৫ সালের বিধিমালাটি আদালত কর্তৃক অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় বাতিল হয়। তাই সেটি অনুসারে গ্রাম পুলিশকে বেতন দেওয়া অন্যায়। আদালতের প্রত্যেক কার্যদিবসে শুনানির তালিকায় থাকলেও এই আইন লড়াই শেষ হচ্ছে না। এখানে সরকারের কোন লিগ্যাল গ্রাউন্ড নেই তাদেরকে বঞ্চিত করার।
ভিক্ষার থালা হাতে গ্রাম পুলিশের অবস্থান কর্মসূচি
এদিকে, গত ২৯ এপ্রিল থেকে টানা ২৬ দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে চাকরি জাতীকরণের ১ দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছেন গ্রাম পুলিশ সদস্যরা। গত ১৩ই মে সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে পেটুয়াখালী, নাটোর, নওগা, ঝালকাঠি, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২০ জন গ্রাম পুলিশ ভিক্ষার থালা হাতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে।
দফাদার লাল মিয়া বলেন, "প্রধানমন্ত্রীর সদয় ঘোষণা ছাড়া আমরা এখান থেকে উঠবো না। আমরা এখানে ভিক্ষা শুরু করেছি সরকারি পোশাকে। আমরা লোক সরকারি, কাজ সরকারি– কিন্তু বেতনের বেলায় অদরকারি।"
তিনি আরো বলেন, "বর্তমানে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকায় একটা সংসার কীভাবে চলতে পারে? আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এ থেকে আমরা মুক্তি চাই। আদালতের রায় অতি দ্রুত বাস্তবায়ন হোক, সেটাই দেশের ৪৬ হাজার পরিবারের একমাত্র চাওয়া। আমরা যে টাকা পাই এটা দিয়ে ৫ জন মানুষের দু'সপ্তাহের বাজার করা যায় না। সন্তানের লেখাপড়া, চিকিৎসার বিষয় তো চিন্তা করাই যায় না।"