ঘূর্ণিঝড় রিমাল: খুলনা, বাগেরহাটে ক্ষতিগ্রস্ত মাছের ঘের, ঝুঁকিতে অন্যান্য ফসল
ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে তৈরি হওয়া জলোচ্ছাস ও অতিবৃষ্টির কারণে খুলনা,বাগেরহাট এলাকার ৭৪ হাজার মাছের ঘের এবং কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
মৎস অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, খুলনা জেলায় প্রায় ৩৮ হাজার ৮০০ চিংড়ির খামার এবং বাগেরহাটের ৩৫ হাজার মাছের ঘের ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ মাছের ঘেরই পানিতে ভেসে গেছে।
খুলনার কয়রা উপজেলারে দশহালিয়ায় ৭ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করেছিলেন সত্তার সানা। রোববার রাতের ঘূর্ণিঝড়ে প্লাবিত হওয়া এই ঘেরের মালিক বলেন, "বছরের মাছ ধরার সিজন কেবল শুরু হয়েছিল। গত ৪ মাস ধরে কেবল বাগদা রেনু ছেড়েছি। এই পূর্ণিমাতে মাছ ধরা শুরু করেছি। ঠিক সেই সময়ে সর্বনাশ হয়ে গেল।"
সত্তার সানা গত ৫ মাসে ঘেরে মাছ ছাড়তে প্রায় ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। একইসঙ্গে ৭ বিঘা জমি লিজ নিতে তার খরচ হয়েছিল এক লাখ ২০ হাজার টাকা। একই গ্রামে তার মত কমপক্ষে শতাধিক ঘেরের মালিকের একইরকম পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন।
মহারাজপুরের ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, "জোয়ারের চাপে ইউনিয়নের দশহালিয়া এলাকায় প্রায় ৫০ মিটার বাঁধ ভেঙে কপোতাক্ষ নদের পানি ঢুকে পড়েছে। এতে অন্তত দুটি গ্রাম ও কয়েকশো চিংড়ির ঘের তলিয়ে গেছে। প্লাবিত হলে তো ঘেরে কোনো মাছই থাকে না।"
মহারাজপুরের মত কয়রার অধিকাংশ চিংড়ির ঘের এখন পানির নিচে। একই অবস্থা পাইকগাছা উপজেলার চারটি ইউনিয়ের। দেলুটি ইউনিয়নের চিংড়ি চাষী মোজাফ্ফার হোসেন বলেন, "৭০ বিঘা জমির চিংড়ি ঘের পানির নিচে চলে গেছে। এখন মাছ ধরে রাখার জন্য ঘেরে খৈল ও চাল ছিটাচ্ছি। তবে পানি পেলে আর মাছ আটকে রাখা যায় না।"
উপকূলীয় খুলনা জেলার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ ইউনিয়নের হাজার হাজার মাছ চাষীর এখন এমন-ই সময় পার করছেন। জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য মতে, জেলায় ৩৮,৮০০ এর বেশি চিংড়ি খামার রয়েছে। যেখান থেকে বছরে ১১,৯৩৭.৭৫ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব কুমার পাল বলেন, "জেলার মধ্যে কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ ইউনিয়নে লবণপানি থাকায় সেখানে চিংড়ি চাষও বেশি হয়। এখন অধিকাংশ ঘের জলোচ্ছ্বাসের পানির নিচে। এতে চাষীরা ব্যপক লোকসানের মুখে পড়বেন। ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব হলে পরিমাণ জানা যাবে।"
একই অবস্থা বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ ও শরনখোলার। প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকে প্রায় ৩৫,০০০ মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উৎকূলীয় অঞ্চলে মাছের ক্ষতিই বেশি হয়েছে বলে জানা গেছে। এরসঙ্গে কিছু সবজি, পানের বরজ, আম, লিচুর ক্ষতি হয়েছে।
ক্ষতির মুখে পাকা ধান
জানা যায়, উপকূলীয় ১৯ জেলায় বোরো ধান কাটা হয়েছে ৯৭.০৮ শতাংশ এবং হাওড়ে শতভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। তবে সারাদেশে এখনো ১৫ শতাংশ ধান কাটা বাকি রয়েছে।
এদিকে, রিমালের প্রভাবে সারাদিন ধরে হওয়া ভারী বৃষ্টিপাতে পাকা ধান ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে জানা গেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, মাঠে বর্তমানে আউশ ধান রয়েছে ৩৮ হাজার হেক্টর। এছাড়া, গ্রীষ্মকালীন ভুট্টা রয়েছে ৯৩ হাজার হেক্টর, তিল ৬৪ হাজার হেক্টর, চীনাবাদাম ৭ হাজার হেক্টর, মুগ ডাল ১৩ হাজার হেক্টর, মরিচ ৩৬ হাজার হেক্টর, সবজি ৩.৩৬ লাখ হেক্টর, আদা ১২ হাজার হেক্টর এবং হলুদ রয়েছে ২৬ হাজার হেক্টর।
ক্ষতির মুখে অন্যান্য ফসল
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সারাদেশেই বর্তমানে নানান ধরনের ফসল মাঠে রয়েছে। যেহেতু ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে সোমবার দেশজুড়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে, ফলে সারাদেশেই মাঠে থাকা ফসলের আংশিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় আরও বলছে, ঝড়ো আবহাওয়ায় পাকা ধান, শাক সবজি, কাচা মরিচ, গ্রীষ্মকালীন তরমুজ, পেঁয়াজ, টমেটোর ক্ষতি হবে সবচেয়ে বেশি। তবে ভুট্টা, আদা, হলুদের জন্য বৃষ্টি সুবিধা হবে বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানায়, উপকূলীয় ১৯টি জেলাই ঝড়ের প্রভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এতে অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
দেড় লাখ ঘরবাড়ি ক্ষতির মুখে পড়েছে, যেখানে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৩৭.৫৮ লাখ মানুষ।