উপকূলজুড়ে রিমালের ক্ষতচিহ্ন: দেড়লাখ ঘর ক্ষতিগ্রস্ত, মৎস্য-কৃষি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি
বরগুনা জেলার বিষখালী নদীতীরবর্তী বড়ইতলার বাসিন্দা আয়নাল মুন্সী। নদীপাড়ের ঘাটে স্বল্প পুঁজির ব্যবসা তার। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে দোকানের কোনো মালামাল রক্ষা করতে পারেননি তিনি।
'সিডরের বৎসর দোহানের [দোকান] মইদ্যে ছেলাম। ওইবার মোর দোহান ভাংছে। কিন্তু সব শ্যাষ হয় নাই। রেমেল মোর দোকানটা ধ্বংস কইরা দি গ্যাছে,' আক্ষেপ করে বলেন আয়নাল।
নিজের ৬০ বছরের জীবনে কখনো এত বিধ্বংসী ঝড় দেখেননি বলে জানান বৃদ্ধ আয়নাল। 'রেমেলের মতন খারাপ ঝড় ষাইট [৬০] বৎসরের লাইফে দেহি নাই। এক-দুই ঘোণ্টা নয় ১৬–১৭ ঘোণ্টা হামলা চলাইছে।'
দোকানের ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামত করতে করতে বিমর্ষ আয়নাল বলেন, এফির [এবার] সিগনালডা সোময় মতন লাগছে, তাই মানুষ কম মরছে। তয় এফির সম্পদের ক্ষতি বেমালা। জানে না মালে খাইছে এফির।'
প্রতি বছরই কোনো না কোনো ঝড় মোকাবিলা করেন বরিশাল ও খুলনা বিভাগের উপকূলীয় জেলার মানুষজন। আর তাদেরকে আগলে রাখতে ঘূর্ণিঝড়ের সামনে নিজেকে মেলে দেয় সুন্দরবন।
খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে এক লাখ ৬০ হাজার ঘর এবারের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোববার (২৬ মে) দেশের উপকূলে আঘাত হানা এ ঝড়ে উপূলীয় অঞ্চলে মৎস্য ও কৃষিখাতের প্রচুর ক্ষতির আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঝড়ে সুন্দরবনের প্রায় ৩৯টি হরিণসহ অন্যান্য প্রাণী নিহত হয়েছে।
দেড়লাখের বেশি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত
ঘূর্ণিঝড় রিমাল রোববার রাতে আঘাত হানলেও সোমবার রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত এর প্রভাব ছিল। প্রবল বাতাস আর বৃষ্টিতে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় কমপক্ষে ৮০ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।
জেলা প্রশাসনগুলোর দেওয়া প্রাথমিক হিসেবের তথ্য অনুযায়ী, বরিশালে চার হাজার, ভোলায় ১০ হাজারের বেশি, বরগুনায় ১৭ হাজার ও পটুয়াখালীতে প্রায় ৩০ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে কয়েক হাজার ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে।
পিরোজপুর জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, সোমবার রাত পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থাকায় মঙ্গলবার ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান শুরু করা হয়। ফলে বুধবারের আগে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব নয়।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল করিম জানান, ঝড়ের তাণ্ডবে খুলনায় ৭৬ হাজার ৯০৪টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এতে ভুক্তভোগী হয়েছেন সাড়ে চার লাখ মানুষ।
সুন্দরবনে বড় আঘাত
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে কাজ শুরু করেছে বন বিভাগ। বনের বিভিন্ন স্থানে মিলছে বন্যপ্রাণীর মরদেহ।
মঙ্গলবার (২৮ মে) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, সুন্দরবনের কটকা ও দুবলা এলাকাসহ বনের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৯টি হরিণের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে অন্তত ১৭টি হরিণ।
এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন বিভাগের ২৫টি টহল ফাঁড়ি। লবণপানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে কমপক্ষে ৮০টি মিষ্টিপানির পুকুর।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, 'রিমালের প্রভাবে বনের ভেতর প্রায় আট থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ফলে বনের উঁচু স্থান তলিয়ে যাওয়ায় প্রাণীগুলোর আশ্রয় নিতে সমস্যায় পড়তে হয়েছে।'
উচ্চ জলোচ্ছ্বাসের ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে না যেতে পেরে হরিণগুলোর মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
খুলনাঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, 'হরিণের পাশাপাশি আরও বন্যপ্রাণী মারা গিয়েছ। সেসব মৃত প্রাণীর খোঁজে বনরক্ষীরা তৎপর রয়েছে।'
সুন্দরবনে মিঠাপানির উৎস ৮০টি পুকুর তীব্র জলোচ্ছ্বাসে লোনাপানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বনকর্মীদের পাশাপাশি প্রাণীরাও সুপেয় পানির সংকটে পড়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, 'কত পরিমাণ গাছ ভেঙেছে, তার হিসেব করা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে গাছের তুলনায় বন্যপ্রাণীই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।'
মৎস্য-কৃষি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, জেলার ২০০ হেক্টর জমির মাছের ঘের ও ৬০৪ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে।
সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের কলবাড়ি গ্রামের ভুক্তভোগী ফজলু গাজী ঝড়ে দুইশো মুরগি হারিয়েছেন। খামার ভেঙে চাপা পড়ে তার মুরগিগুলো মারা গিয়েছে। 'দেড় লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমার ছোট্ট এ মুরগির খামারটি ছিল ব্যবসার অন্যতম মাধ্যম,' বলেন তিনি।
খুলনাঞ্চলের উপকূলীয় মানুষের উপার্জনের অন্যতম উৎস মাছচাষ। তবে রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ওই অঞ্চলের অধিকাৎশ মাছের ঘের প্লাবিত হয়।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব কুমার পাল বলেন, 'আমাদের জেলায় ২৪৫ কোটি টাকার মাছ ও মাছচাষের অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।'
৩৮টি ইউনিয়ের তিন হাজার ৬০০টি পুকুর, নয় হাজার ১১৫টি ঘের ও এক হাজার ৩৫৬টি কাঁকড়া-কুচিয়া খামার পানিতে প্লাবিত হয়েছে বলে জানান তিনি।
মৎস্য অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'এখন একেবারেই মৌসুমের শুরুর দিকে ছিল। চাষীরা কেবল চিংড়ি মাছ ধরবেন — এর মধ্যেই ভেসে গেল।'
ঝড়ের কবলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খুলনার কৃষি সম্পদও। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, খুলনাতে ১২ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমির ফসল ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে। আউশের বীজতলা, তিল, মুগডাল, মরিচ, আদা, হলুদ, চিনাবাদাম, ভুট্টা, পেঁপে, কলা, পান ও আখ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
'আমারা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা ঢাকাতে পাঠিয়েছে। তাদের প্রণোদনা দিয়ে সহায়তার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে,' বলেন তিনি।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে পটুয়াখালীতে আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে ২৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করেছি।'
পটুয়াখালীর পাশাপাশি ভোলা ও বরগুনাতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নির্দিষ্ট তথ্য না পাওয়া গেলেও মৎস্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় অফিস থেকে জানা গেছে, কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে।
তবে সমুদ্রে মা ইলিশ রক্ষায় ৬৫ দিনের অভিযান চলায় বিভাগের সকল জেলেরা স্থলে অবস্থান করছিলেন। তাদের নৌকাগুলোও নোঙর করা ছিল। ফলে প্রাণহানি ও জেলেদের ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস।
তিনি বলেন, 'জেলেদের ক্ষতি না হলেও মৎস্যচাষীরা পথে বসেছেন। এখন পর্যন্ত যে তথ্য এসেছে, তাতে ৫০ শতাংশ মৎস্যচাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।'
বেড়িবাঁধ ভেঙে মাছ-কৃষির ক্ষতি
মৎস্য ও কৃষি সম্পদের এত বেশি ক্ষতির মূল কারণ উকূলীয় এলাকাগুলোর বিভিন্ন নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়া। পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, 'খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার ৩৮টি স্থানে চার কিলোমিটারের বেশি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।'
পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশাল থেকে জানানো হয়েছে, বিভাগের বেড়িবাঁধের ১৫৮টি দুর্বল স্থানসহ কমপক্ষে ৪০০ স্থান ভেঙে পানি প্রবাহিত হয়েছে।
বরিশাল পাউবো দক্ষিণাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হান্নান বলেন, 'আমরা ক্ষতিগ্রস্ত স্থান শনাক্তে কাজ করছি। যেসব স্থানে ভেঙেছে তা দ্রুত মেরামতে কাজ চলছে।'