এবার দিনাজপুরের লিচু বাজারে কম: অতিরিক্ত গরম, অনাবৃষ্টির ধাক্কা ফলনে
স্বাদের জন্য বিখ্যাত দিনাজপুরের লিচু। সারা দেশেই রয়েছে এর চাহিদা। তাই মৌসুম এলেই দিনাজপুরের লিচুর জন্য অপেক্ষায় থাকেন সবাই। কিন্তু এবার বাজারে দিনাজপুরের লিচু পাওয়া যাচ্ছে কম। তারচেয়েও খারাপ খবর হচ্ছে, এ লিচুর ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
কৃষক এবং কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়েছে দিনাজপুরের লিচুর ওপর। পাকার আগেই ফেটে যাচ্ছে লিচু। রোদের প্রখর তাপে পুড়ে যাচ্ছে সুস্বাদু এই মৌসুমী ফলের চামড়াও। এখন ফলন কমে গেছে আগের চেয়ে। ফলে আগামীতে দিনাজপুরের লিচুর চাষাবাদ করা যাবে কি না, তা নিয়েই দেখা দিয়েছে সংশয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার দিনাজপুর জেলায় জাতভেদে প্রতি হাজার লিচু বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে ৫ হাজার টাকায়। অন্যান্য বছরে দিনাজপুরে গড়ে ৭০০ কোটি টাকার লিচু উৎপাদন হলেও এবার সেখানে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। তবে দিনাজপুরের লিচু জেলার চাহিদা মিটিয়ে এখনও যাচ্ছে দেশের অন্যান্য জেলাতে। সুমিষ্ট হওয়ার কারণে প্রতি বছরেই বাড়ছে চাহিদা।
কিন্তু চাহিদা থাকলেও এবার অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ আর অনাবৃষ্টির কারণে দিনাজপুরে লিচু চাষিদের এবার লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। চাষিরা বলছেন, প্রথমদিকে প্রচণ্ড তাপদাহে লিচুর মুকুল ঝলসে গেছে। মাঝখানে ঝরে পড়ছে লিচুর গুটি। শেষের দিকে পাকার আগেই ফেটে যাচ্ছে লিচু। রোদের প্রখর তাপে পুড়ে যাচ্ছে এই সুস্বাদু ফলের চামড়াও। সবমিলিয়ে জেলায় এবার লিচুর ফলন অন্তত ৩০ শতাংশ কম হবে।
দিনাজপুরের ব্যবসায়ী ও চাষিরা জনান, অন্য বছর এ সময়ে ফলের ভারে নুয়ে পড়ত দিনাজপুরের লিচু গাছগুলো। ফল বাঁচাতে দিতে হতো বাঁশের খুটি। অথচ এ বছর গাছে লিচুর সংখ্যা খুবই কম। কোনো কোনো ডাল একেবারেই ফলশূন্য।
আরও পড়ুন: ঢাকাসহ সারাদেশে যেভাবে পৌঁছায় রাজশাহীর আম
এবার লিচু রক্ষা করতে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে বলে জানান দিনাজপুরের বিরল উপজেলার চাষি মতিউর রহমান। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে ৬০০ লিচুর গাছ চাষাবাদ করে আসছেন। এই চাষি বলেন, তীব্র দাবদাহ এবার চাষিদের ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে ফেলেছে। গত ১০ বছরের মধ্যে এবার ফুল এসেছিল সবচেয়ে বেশি। মৌসুমের শুরু থেকেই তাপদাহ। কৃষি বিভাগের পরামর্শে গাছে পানি দিয়েও রক্ষা করা যায়নি। গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। ফলন নেমেছে প্রায় অর্ধেকে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা লিচুর জন্য আদর্শ আবহাওয়া। কিন্তু এ বছর জেলায় তাপমাত্রার পারদ ছুঁয়েছে ৪০-এর ঘর। রাতের তাপমাত্রাও ছিল বেশ উষ্ণ।
বিরল উপজেলায় প্রায় ৯০০ লিচুর গাছ আছে মোহাম্মদ শিশির শাহ-এর। ৩০ একর জমিতে বাগান করেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে। তিনি বলেন, 'শুধু আমার নয়, গত পাঁচ বছরের তুলনায় এবার উপজেলায় অন্তত ৩০ শতাংশ লিচু কম উৎপাদন হয়েছে। লিচুর জন্য যে তাপমাত্রা দরকার, তা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের (বৈশ্বিক উষ্ণতা) সরাসরি ইমপ্যাক্ট (প্রভাব) পড়েছে লিচুর ওপরে।'
লিচু চাষি ও কৃষি কর্মকর্তারা জানান, এই ফলের আদি নিবাস চীনে। চীনের যে এলাকায় এর উৎপত্তি, সেখানে মুকুল আসার আগে তাপমাত্রা ঠান্ডা থাকে। রাতের তাপমাত্রা থাকে ১০ ডিগ্রির নিচে। দিনাজপুর অঞ্চলেও লিচুর ফুল আসার আগে রাতের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে থাকত কয়েক বছর আগেও। কিন্তু এখন সেই পরিস্থিতি নেই। শীতকালেও শীতের তীব্রতা কমে গেছে। গরমের তাপমাত্রা বেড়েছে ক্রমাগত।
মোহাম্মদ শিশির বলেন, গত দুই-তিন বছর ধরে মুকুল আসার সময়ে প্রচণ্ড তাপদাহ থাকে। যদিও সাইক্লোনের প্রভাবে এবার বৃষ্টির কারণে লিচু কিছুটা রক্ষা পেয়েছে। নইলে যে লিচুগুলো আছে, সেগুলোও থাকতো না। এসবের ফলের কৃষকদের মধ্যে লিচু চাষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। লোকসানেও পড়ছেন অনেকে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি বছরে দিনাজপুরে ৫ হাজার ৪৮৯ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ হচ্ছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ১১৭ মেট্রিক টন। গত বছর জেলায় ৪ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। ২০২২ সালে জেলায় ৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়। এ বাগানগুলোতে লিচু উৎপাদন হয় প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন।
সংস্থাটি বলছে, সাধারণত আবহাওয়ার বৈচিত্র্য ও মাটির গুণাগুণের কারণে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় অঞ্চলের লিচু দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে ভালো হয়। এই অঞ্চলে লিচুর চাষাবাদ টিকাতে হলে গরমের সময় পানি ও মালচিং পদ্ধতি ব্যবহারের কথা বলছেন কৃষিবিজ্ঞানীরা।
তবে কৃষিবিজ্ঞানীদের কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে চাষি মোহাম্মদ শিশির বলেন, 'বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা সেভাবে মাঠে থাকেন না বলেই এভাবে বলতে পারছেন। পানির এখন অভাব নেই। পানি দিচ্ছে মানুষ দিনরাত। কিন্তু প্রকৃতি তো ভিন্নপথে চলছে। গবেষণাগারে বসে একটি গাছে পানি দিয়ে মালচিং করে লিচুর ফলাফল দেখানো সম্ভব। কিন্তু হাজার হাজার গাছে এভাবে পানি দেওয়া কঠিন। কৃষক চাইলেই তো রাতের তাপমাত্রা নিচে নামাতে পারবে না। দিনের ক্ষেত্রেও তা-ই।'
দিনাজপুরের আউলিয়াপুর এলাকায় গত পাঁচ বছর ধরে বাজার ইজারা নিয়ে লিচুর চাষ ও ব্যবসা করছেন মোসাদ্দেক আলী। এই তরুণ উদ্যোক্তা জানালেন, গত পাঁচ বছরে লিচুর এমন সংকট তিনি আর কখনও দেখেননি। এবার অন্য এলাকার চেয়ে সদরে মাদ্রাজি ও বেদানা জাতের লিচুর ফল প্রায় ৬০ শতাংশ কম হয়েছে।
তিনি বলেন, 'যেভাবে গরম বাড়ছে, তাতে তাপমাত্রা-সহিষ্ণু লিচু উদ্ভাবন করতে হবে। শত বছরের জাত থেকে বের হয়ে আসতে হবে।'
বৈরী আবহাওয়ার কারণে লিচুর ফলন কম হচ্ছে বলে স্বীকার করলেন দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা জাফর ইকবালও। তিনি বলেন, 'এবারে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম। তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। মাটিতে যে পানি থাকার কথা ছিল তা নেই। এই কারণে লিচুর ফলন কিছুটা কম। এটি মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।'
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিনাজপুরে লিচু উৎপাদনের ক্ষেত্রে জাতের কেনো পরিবর্তন আনা দরকার কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে জাফর ইকবাল বলেন, 'তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় লিচু চাষে কিছু টেকনিক প্রয়োগ করতে হবে। নিয়মিত পানি দিতে হবে। মালচিং পদ্ধতি চালু করতে হবে। আর নতুন জাত উদ্ভাবনের কাজ করে ফল গবেষণা কেন্দ্র।'
ফল গবেষণা কেন্দ্রও তীব্র দাবদাহে লিচুর চাষে ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে বলছে। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হাবিবুল আলম বলেন, 'গবেষণার মাধ্যমে লিচুর উন্নত জাত বা কোনো ফলের নতুন জাত কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে অন্তত ১২ বছর লাগে। বর্তমানে আবহাওয়া-সহিষ্ণু কোনো লিচুর জাত আমাদের নেই। আমাদের পরামর্শ হলো, বর্তমান জাতের লিচুর গাছে পানি সেচ, স্প্রে ও হরমোন ব্যবহার প্রক্রিয়ায় সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে। তাহলে সংকট কিছুটা সমাধান করা সম্ভব। এতে প্রচলিত জাতই আমাদের দেশে স্থায়িত্ব লাভ করবে। দেশের অন্যান্য চাষিদের ক্ষেত্রেও আমাদের একই পরামর্শ।'