স্বাদ-পুষ্টিতে অতুলনীয় বেদেনা লিচু
বেদেনা লিচু। নামটা মুখে আনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে টসটসে লাল, আকারে বড় রসালো ফলের ছবি। এই জাতের লিচু মূলত দিনাজপুর ছাড়া অন্য কোথাও হয় না। আবার কোনো কোনো জায়গায় আবাদ করা হলেও, দিনাজপুরের মাটিতে উৎপাদিত বেদেনা লিচুর যে আকার-আকৃতি, স্বাদ-গন্ধ, মিষ্টতা ও রস- তা অন্য জায়গার মাটিতে হয় না।
ফলে দিনাজপুরের ব্র্যান্ডিং হয়ে উঠেছে কাঠারীভোগ চাল ও বেদেনা লিচু। শুধু ব্র্যান্ডিংয়ে নয়, অন্যান্য জাতের তুলনায় এই জাতের লিচু দামেও দ্বিগুণ অথবা তারও বেশি। তবু বেদেনা লিচুর গ্রাহকের সংখ্যা বেশি; চাহিদাতেও নেই ভাটা।
জেলা ব্র্যান্ডিং ও বেদেনা লিচুর এসব তথ্য জানিয়েছেন দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ তৌহিদুল ইকবাল।
তিনি আরও জানান, এবারে দিনাজপুর জেলায় প্রায় ছয় হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে লিচু আবাদ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টন। দিনাজপুরে মাদ্রাজি, বোম্বাই, বেদেনা, চায়না থ্রি, কাঠালী, হাড়িয়াসহ বেশ কয়েক প্রকারের লিচুর আবাদ হয়। যার মধ্যে খুবই অল্প পরিমাণ জমিতে বেদেনা জাতের লিচুর আবাদ হয়।
মোট আবাদি জমির মধ্যে বেদেনা জাতের লিচুর আবাদের পরিমাণ ১০ শতাংশ আর চায়না থ্রি জাতের লিচু আবাদের পরিমাণ ২০ শতাংশ বলে জানিয়েছেন তিনি।
কৃষিবিদ তৌহিদুল ইকবাল জানান, দাম বেশি হওয়ায় বেদেনা লিচুর কোয়ালিটিও ভালো। তাছাড়া এই জাতের লিচু সব মাটিতে হয় না। এ কারণে দিনাজপুরের বিশেষত্ব হিসেবে জাতটিকে ধরা হয়।
'একমাত্র দিনাজপুরেই এর বেশি আবাদ এবং কোয়ালিটি ভালো হয়। তাই দিনাজপুরের ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে কাঠারীভোগ চাল ও বেদেনা লিচু। দেশের সব প্রান্তেই এই জাতের লিচু বিখ্যাত এবং চাহিদা রয়েছে সব ধরনের মানুষের মধ্যে,' বললেন কৃষিবিদ তৌহিদ।
দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মারুফ আহমেদ বলেন, 'আমরা বেদেনা জাতের লিচুর পুষ্টি গুনাগুণ নির্ণয় করেছি। এই জাতের লিচুতে প্রতি ১০০ গ্রামের মধ্যে সুগারের পরিমাণ ৩২-৪১ মিলিগ্রাম। অন্যদিকে, ভিটামিন সির পরিমাণ ২৪-৪৭ মিলিগ্রাম, টোটাল ফেনলের পরিমাণ ৬৯৯-১২১২ মাইক্রোগ্রাম, টোটাল ফ্লেবানয়েট ২০৭-৬৩১ মাইক্রোগ্রাম, এসিডিটি ০.৭১-০.৮৪ শতাংশ ও পিএইচ ৪.৩৪-৪.৮৩।'
তিনি আরও বলেন, 'লিচুর জাতভেদে এসব পরিমাণের পরিবর্তন হয়। আমরা শুধু বেদেনা জাতটিতে এসব পেয়েছি; অন্যান্য জাতে নির্ণয় করিনি। বেদেনা লিচুসহ অন্যান্য জাতের লিচু নিয়ে আমরা গবেষণা করছি। কোনো রাসায়নিক ছাড়া কাইটোসান পদ্ধতিতে বেদেনা লিচুর উৎপাদন, পুষ্টি গুনাগুণসহ যাবতীয় বিষয় নিয়ে চলছে এই গবেষণা। আগামী বছরগুলোতে অন্যান্য জাত নিয়েও গবেষণা করা হবে। আর সেটি হলে তখন এসব পুষ্টিগুণ আলাদাভাবে নির্ণয় করা যাবে।'
দিনাজপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ প্রদীপ কুমার গুহ জানান, এবারে জেলায় লিচু ব্যবসার টার্গেট ছিল ৪০০-৪২৫ কোটি টাকা। তবে এবারে দাম একটু বেশি হওয়ায় প্রায় ৪৪০ কোটি টাকার লিচু বেচাকেনা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে বেদেনা জাতের লিচুর ব্যবসা হবে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা।'
তিনি আরও বলেন, 'বেদেনা লিচু সুস্বাদু, রসালো, মিষ্টি ও সুগন্ধযুক্ত। এই লিচুর শাসের পরিমাণ বেশি, রসালো ও বিচি ছোট। লিচুটি আকারে বড় হয়। অন্যান্য জাতের লিচুর তুলনায় বেশি মিষ্টতা ও সুগন্ধ থাকলেও বেদেনার ফলন কম হয়। তবে দেশব্যাপী এই লিচুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।'
'চাহিদা বেশি ও আকার-আকৃতি বড় হওয়ার কারণে সবসময়ই এই লিচুর দাম বেশি থাকে। অন্যান্য লিচুর তুলনায় এই লিচু দ্বিগুণ অথবা তারও বেশি দামে বেচা-কেনা হয়। তবে বাণিজ্যিকভাবে যদি কেউ লিচু উৎপাদন করে, তাহলে বোম্বাই জাতের লিচু আবাদ করাই ভালো,' যোগ করেন তিনি।
প্রদীপ কুমার গুহ জানান, লিচুর সব জাতের পুষ্টিগুণ মোটামুটি একই রকমের। তবে মাটির গুনাগুণের উপর মিষ্টতা ও স্বাদের গুনাগুণের তারতম্য হয়। অবশ্য মাদ্রাজি জাতের লিচু টকের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। এবারে প্রতি একশটি বেদেনা জাতের লিচু বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে, যেখানে গত দুই বছরে এই জাতের লিচুর দাম ছিল ২৫০-৩৫০ টাকা।
চলতি বছর মাদ্রাজি বা বোম্বাই জাতের লিচু বিক্রি হয়েছে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা প্রতি শ' হিসেবে। এছাড়া নতুন জাতের লিচু বারী-৪ এসেছে। আকার ছোট হলেও এর স্বাদ ও গুণ বেদেনার মতোই হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।