লোকসানের শঙ্কায় দিনাজপুরে অপরিপক্ব লিচু বাজারে
বাগানভর্তি লিচুর গাছের সমারোহ, আর সেই গাছের গোড়ায় বসে আট থেকে দশ জন লিচু বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত, কেউবা কাজ করছে গাছ থেকে লিচু ছেঁড়ার। এদের মধ্যেই লিচু গণনার কাজ করছেন দুই থেকে চার জন শ্রমিক। একেকটি ঝাঁকায় ৫০ থেকে ৫৩টি করে লিচু বেঁধে সাজিয়ে রাখছেন লিচু গাছের গোড়ায়। লিচুর ঝাঁকায় যে সব লিচু দেখা যাচ্ছে তার সঠিক পরিপক্বতা আসতে আনুমানিক আরও সপ্তাহখানেকের মত সময় লাগবে।
এমন চিত্রের দেখা মিলেছে দিনাজপুর সদর উপজেলার মাসিমপুর এলাকার লিচু বাগানগুলোতে। লিচুর সঠিক পরিপক্বতা আসার আগেই এসব লিচু বাছাই করা হচ্ছে বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে। পরিপক্ব হয়ে লিচু বাজারে উঠার এখনও সঠিক সময় হয়নি। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দাবি লিচু ফেটে যাওয়া ও লোকসানের আশঙ্কা থেকেই অসময়ে তাদের এই পদক্ষেপ। কৃষিবিদরা বলছেন, অপরিপক্ব লিচু স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ক্ষতিকর। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিও করেছেন কৃষি কর্মকর্তারা।
মাসিমপুরের লিচু বাগান ঘুরে দেখা যায়, আইয়ুব আলী তার লিচু বাছাইয়ের শ্রমিককে তাগিদ দিচ্ছেন, 'তাড়াতাড়ি লিচুগুলা বাছো বাহে, ফাটা লিচু ঝোঁকাত দেন না ফের, আর কাঁচা-পাঁকা মিশাল করি ঝোকা বানধো' বলে।
আইয়ুব আলী একজন লিচু চাষী। তার বাগানে গিয়ে কথা হয় তার সাথে, আলাপচরিতার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, 'আমার দশটি বাগান রয়েছে, এরমধ্যে আজকে একটি বাগানের ৩০টি গাছের লিচু ভেঙেছি। এসব গাছ থেকে লিচু পেয়েছি মাত্র দশ হাজারের মত। আমার দশটি বাগানে এ বছর লিচু নেই বললেই চলে, ৪০-৫০ হাজারও হবে কি না সন্দেহ আছে! এ বছর অগ্রিম লিচু ভাঙা শুরু করেছি, কেননা এ বছর লিচুর কিছু রোগ এসেছে। লিচু গাছের গোড়ায় পোকা ধরছে, গাছে গাছে লিচু ফেটে যাচ্ছে। তার উপর বাদুরের অত্যাচার-ফলে এ বছর লিচুর ফলন এমনিতেই কম। গত বছরও আমরা কৃষকেরা ভালো দাম পাইনি। যদি আগাম লিচুগুলো না ভাঙা শুরু করি তবে এ বছরও লোকসান গুনতে হবে।'
আরেক লিচু চাষী মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী বলেন, বাজারে অতিরিক্ত চাহিদা থাকার ফলে কাঁচা অবস্থায়ই লিচু ছিঁড়তে হচ্ছে গাছ থেকে। আবহাওয়ার তারতম্যে, আর অনাবৃষ্টির ফলে গাছে গাছে লিচু ফেটে যাওয়ার অভিযোগের পাশাপাশি ভরা মৌসুমে কৃষি কর্মকর্তার বেশি বেশি পরামর্শের দাবি রয়েছে এই বাগানীর। তিনি বলেন, 'অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর লিচুর ফলন খুবই কম, গাছে লিচু নেই বললেই চলে। গত বছরের তুলনায় চার ভাগের একভাগ লিচু এবার পেয়েছি। যেটুকু আছে এতে করে হয়তো কিছু টাকা আমরা পাবো। কারণ, বাজারে বর্তমান সময়ে ব্যাপক লিচুর চাহিদা রয়েছে। গাছ থেকে বেশিরভাগ লিচু কাঁচা-কাঁচা পাড়তে বাধ্য হচ্ছি, লিচুগুলো পাঁচ-সাতদিন পরে পাড়লে হয়তো ভালো হতো। কারণ এ বছর বাজারে লিচুর চাহিদা ব্যাপক। লিচুর 'পার্টি' বলছে এই সব লিচুই (কাঁচা-কাঁচা লিচু) তারা নেবে।
আবহাওয়ার কারণে এ বছর পানির সংকট ছিল, বৃষ্টি নেই- ফলে অনেক লিচু গাছে গাছে ফেটে যাচ্ছে। তাই দিয়ে দিচ্ছি (বিক্রি করছি)। তবে লিচু মৌসুমে যদি কৃষি কর্মকর্তাদের বেশি বেশি পরামর্শ পাই তবে হয়তো লিচু আরও ভালো করে চাষবাস করা যাবে, আমরাও লাভবান হব'।
গত বছর করোনার কারণে অনেক লিচু চাষী গুনেছেন লোকসানের অঙ্ক। এ বছরে লাভের আশায় বুক বাঁধলেও বাধ সেধেছে গাছের কম ফলন। তার উপর গাছের লিচু ফেটে যাওয়া নিয়ে চাষীর পড়েছেন বিপাকে। এ যেন লিচু চাষীর নিকট 'মরার উপর, খড়ার ঘাঁ' হয়ে দাড়িয়েছে। তাই এ বছর গাছের ফেটে যাওয়া লিচু নিয়ে লোকসানের অঙ্ক কম গোনার লক্ষ্যে হালকা রঙ ধরতেই লিচু বাজারজাত করছেন লিচু চাষীরা।
মাথায় হাত দিয়ে বাগানের ফেটে যাওয়া লিচুর গাছ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন জামিল হোসেন। তিনি বলেন, 'গত বছর করোনা ভাইরাসের কারণে আমরা লিচু ভালো মত বিক্রি করতে পারি নাই। কম দামে দিয়ে দিতে হয়েছিল। অনেক লস (লোকসান) হয়েছে। এ বছর গাছে তেমন একটা লিচু নাই, তার উপর আবহাওয়া খারাপ। বিষ (কীটনাশক), ভিটামিন দেয়ার পরও গাছে লিচুগুলো ফেটে ফেটে যাচ্ছে। এই নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। তাছাড়া করোনার কারণে গাড়ি-ঘোড়া ঠিকমত যাচ্ছেনা। এ কারনে কাঁচা থাকতেই লিচুগুলো পাড়তে হচ্ছে। না হলে গাছে লিচুগুলো ফেটে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে। এবারও লস খাবো। তাছাড়া লিচুও কম আসছে গাছে, তাই আগেভাগেই লিচু ভাঙছি'।
গাছের গোড়ায় একইভাবে মাথায় হাত দিয়ে ফেটে যাওয়া লিচুর দিকে তাকিয়ে ছিলেন আজগার আলী। তিনি বলেন, 'এ বছর বাগানে অনেক লস। গত কয়েক দিন আগের পশ্চিয়া (পশ্চিমা) বাতাসে গাছের লিচুগুলো অনেক ফেটে গেছে। এ ফেটে যাওয়া লিচু দেখে আমাদের মাথা ঘুরছে। এ কারণে লিচুগুলো কাঁচায় কাঁচায় বিক্রি করে দিচ্ছি, আর তাছাড়া আকাশের অবস্থাও খুব খারাপ। ঝড়-বাতাস খুব বেশি হলে গাছগুলো আমাদের ভেঙে পড়তে পারে। তখন তো আরেক অসুবিধাতে পড়তে হবে। গাছে লিচুর পরিমাণও কম, অনেকগুলো গাছ খালি পড়ে আছে, কোনো লিচু নাই'।
বর্তমান জেলা শহরের বড় লিচু বাজার বসে কোতয়ালী থানার সামনে খানিক এগিয়ে 'নিউ মার্কেটে'। তবে করোনা মহামারির কারণে দুই বছর ধরে দিনাজপুর লিচু বাজার গোড়-এ শহীদ বড়মাঠে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতেও লিচু বিক্রি হয়, যেমন পুলহাট বাজার, বাহাদুর বাজার, শহর কোতয়ালী থানার গেটের সামনে। পুলহাট বাজারে লিচু কিনতে দেখা যায় জাহাঙ্গীর আলমকে। তিনি বলেন, 'লিচুর বাজারে মৌসুমের প্রথম লিচু এসেছে তবে লিচুগুলো দেখছি কাঁচাপাকা। নতুন ফল হিসেবে আমি নিলাম লিচু, নতুন ফল যেহেতু খেতে তো হবে। তাছাড়া দিনাজপুর তো লিচুর জন্য বিখ্যাত। বাজারে প্রথম তো মাদ্রাজী লিচুই বের হয়। এরপর বেদানা, চায়না-থ্রি বের হবে'।
বাজারে লিচুর থোক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে মেরিনা বেগম বলেন, 'আমি বাজারে এসেছি লিচু দেখার জন্য। বিক্রেতারা যেসব লিচু বিক্রি করছে, তার অধিকাংশই কাঁচা। এসব লিচু খেলে শরীরে নানা ধরনের অসুবিধা হবে। আবার কিছু পাকা রয়েছে, কিন্তু সেটা মনের মত নয়। তারপরেও খেতে হয়'।
দিনাজপুর গোড়-এ শহীদ বড়মাঠে স্থানান্তরিত লিচু বাজারে গিয়ে দেখা যায় কয়েকটি দোকানঘরে লিচু ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ চলছে। এ জেলার ১৩টি উপজেলাতে লিচুর চাষ হয়ে থাকে। তার মধ্যে সিংহভাগ লিচু চাষ হয় সদর ও বিরল উপজেলায়। এসব লিচুর মধ্যে রয়েছে মাদ্রাজী, চায়না-থ্রি, বোম্বাই, বেদানা, কাঁঠালী লিচু। বাজারে বর্তমান সময়ে মাদ্রাজী জাতের লিচুর আমদানি বেশি।
বড়মাঠে গিয়ে ভাইবোন আড়তে গিয়ে কথা হয় সুমন ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, 'এবার কৃষরা কাঁচাকাঁচা লিচু ভেঙে নিয়ে আসছে। কারণ গাছে লিচু ফেটে যাচ্ছে। গাছে লিচু ফেটে যাওয়ার কারণ গরম হাওয়া, এই গরম হাওয়া লিচুর গায়ে পড়লে লিচু শুকিয়ে যায়, ফেটে যায়। গত বছর লিচুর জন্য কৃষকের লোকসান হয়েছে। এ বছর এমন হলেও কৃষকের লোকসান হবে। তাই তারা কাঁচা থাকতেই লিচু ভেঙে আনছে লাভের আশায়। বর্তমান বাজারে এক হাজার থেকে ১৮'শ টাকা হাজার দরে মান্দ্রাজী (মাদ্রাজী) লিচু বিক্রি হচ্ছে। বাকি লিচুর মধ্যে যেমন চায়না-থ্রি, কাঁঠালী, বেদানা লিচু উঠতে সপ্তাহখানেকের মত সময় লাগবে'।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, মাদ্রাজী জাতের লিচু পরিপক্ব হয় মে মাসের শেষের দিকে আর বোম্বে ও বেদানা জাতের লিচু পরিপক্ব হয় জুন মাসের ১০ তারিখের পর। সবশেষে পরিপক্ব হয় চায়না-থ্রি ও কাঁঠালী জাতের লিচু। দিনাজপুরে প্রায় ৬ হাজার ৫৪৬ হেক্টর জমিতে লিচু গাছ রয়েছে। প্রতি বছরে জেলায় প্রায় সোয়া ৪শ' থেকে সাড়ে চারশ' কোটি টাকার লিচু বিপণন হয়।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ প্রদীপ কুমার গুহ বলেন, 'অপরিপক্ব লিচুতে জৈবিক এসিডের পরিমাণ বেশি থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমরা বাজার পরিদর্শনে অপরিপক্ব লিচু বাজারজাতের বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। লিচু ফেটে যাওয়ার বিষয়টি সমাধানযোগ্য। এজন্য বাজারে অপরিপক্ব লিচু নিয়ে এসে বিক্রি করা স্বাস্থ্যহানিকর একটি ব্যাপার। আমরা কৃষকদের সাথে কথা বলছি, তাদেরকে পরামর্শ দিচ্ছি। এসব অপরিপক্ব লিচু যেন বাজারে না আসে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে'।
'এবারে গাছে লিচু কম এসেছে। তাই যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তা হয়তো পূরণ নাও হতে পারে', যোগ করেন তিনি।