যে কারণে কক্সবাজারে প্যারাসেইলিং সাময়িক বন্ধ করা হলো
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে প্রতিদিনই ছুটে যান হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু। মেরিন ড্রাইভ, ইনানী, হিমছড়ি, পাতুয়ারটেক ও দরিয়ানগরে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি পাহাড় ও সাগরের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে করেন প্যারাসেইলিং।
কিন্তু এই প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে অনেকেই জীবনের ঝুঁকিতে পড়ছেন। কারণ যারা প্যারাসেইলিং পরিচালনা করছেন তাদের মধ্যে অনেকেই অদক্ষ। প্রশাসনের নির্দেশনা ও শর্ত মানছেন না তারা।
সম্প্রতি প্যারাসেইলিং করার সময় দুর্ঘটনায় শিকার হয়েছেন কয়েকজন পর্যটক। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি গণমাধ্যমে।
এর জের ধরে আজ (১০ জুন) থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত প্যারাসেইলিং পরিচালনা কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) মো. মাসুদ রানা বলেন, পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত প্যারাসেইলিং পরিচালনা কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে।
তিনি বলেন, ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি যাচাই বাছাই ও সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা টেকনিক্যাল টিম কর্তৃক মূল্যায়ন সাপেক্ষে পুনরায় চালু করে দেওয়া হবে।
তিনি আরো জানিয়েছেন, প্যারাসেইলিং বিষয়ে অভিজ্ঞ বিমানবাহিনীর কমান্ডো অফিসার, নৌবাহিনীর দক্ষ প্রশিক্ষক, লাইফ গার্ড ট্রেইনারসহ টেকনিক্যাল টিম সামগ্রিক মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
মো. মাসুদ রানা বলেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বিমানবাহিনীর কমান্ডো অফিসার, নৌবাহিনীর দক্ষ প্রশিক্ষক, লাইফ গার্ড ট্রেইনার দিয়ে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ শুরু হবে। যারা প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হবে, তাদেরকেই প্যারাসেইলিং পরিচালনার অনুমতি দেয়া হবে।
তিনি বলেন, "একই সঙ্গে প্রতিমাসেই এই মূল্যায়ন কার্যক্রম চলবে। কারণ আমরা চাই, কক্সবাজার ভ্রমণে আসা প্রত্যেক পর্যটক নিরাপদে ভ্রমণ করুক।"
প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা
প্যারাসেইলিং আকাশে উড়ে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর অনুভূতি। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের আকাশে উড়ে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে আরো নতুন মাত্রা যোগ করে সমুদ্রের পাশের সবুজ পাহাড়।
কক্সবাজারের সৈকতের দরিয়ানগর পয়েন্টে প্যারাসেইলিং এর বেসরকারি উদ্যোগে গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও সৈকতের এই প্যারাসেইলিং একটু ব্যয়বহুল বলে প্রচারণা থাকলেও আগত পর্যটকরা নানাভাবে প্যারাসেইলিং এর মাধ্যমে আকাশে উড়ে বেড়ানোর অনুভূতি গ্রহণ করেন।
কিন্তু যারা প্যারাসেইলিং পরিচালনা করছেন তাদের অদক্ষতায় পর্যটকরা জীবনের ঝুঁকিতে পড়ছেন, শিকার হয়েছেন দুর্ঘটনার।
ঢাকার নিউ ইস্কাটনের নারী পর্যটক আফসান জেবিন অদিতি কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছিলেন গত ২২ মে। ২৪ মে বিকালে দরিয়ানগর পয়েন্টে গিয়ে 'ফ্লাই এয়ার সী স্পোর্টস প্যারাসেইলিং' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের টিকেট কাটেন ২ হাজার টাকায়। কিন্তু প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে তিনি দুর্ঘটনার শিকার হন। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিরাপত্তার অভাব থাকার বিষয়টি নিয়ে লেখেন।
'ফ্লাই এয়ার সী স্পোর্টস প্যারাসেইলিং' এর মালিক মোহাম্মদ ফরিদের সাথে কথা বলেছেন প্রতিবেদক। তিনি নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার নন বলে স্বীকার করেছেন। তবে দুর্ঘটনার পেছনে ভিন্ন অজুহাত দিয়েছেন তিনি।
তিনি জানিয়েছেন, তারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই প্যারাসেইলিং করেন। ২৪ মে এর দুর্ঘটনা অসাবধানতার জন্য ঘটেছে। ২৪ মে ঘটনাকে পুঁজি করে একটি পক্ষ তার ব্যবসা বন্ধ করতে চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ দিয়েছেন তিনি।
'পক্ষটি কে?' এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "সৈকতের যে পয়েন্টটি আমি ব্যবহার করি ওখানে অন্য কেউ ব্যবসা করতে চায়। তারাই দুর্ঘটনাটি নিয়ে অপতৎপর হয়েছে।"
কিন্তু দুর্ঘটনায় শিকার পর্যটকদের সাথে ঐ পক্ষের কি সর্ম্পক তা জিজ্ঞাসা করা হলে কোন সঠিক জবাব দিতে পারেননি তিনি।
প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে দুর্ঘটনার ঘটনা প্রায়ই ঘটে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের নিয়োগকৃত একজন বীচকর্মী। তিনি নাম না প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গত ১৯ মে একই প্রতিষ্ঠানে প্যারাসেইলিং করতে গিয়ে একজন পর্যটক দড়ি ছিঁড়ে নিচে পড়ে সমুদ্রে ডুবে যান। অন্য একটি স্পিডবোট নিয়ে বীচকর্মীরা ঐ পর্যটককে উদ্ধার করেন। তিনি গুরুতর আহত হয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ রানার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন, ১৪টি শর্ত সাপেক্ষে প্যারাসেইলিং পরিচালনার অনুমতি প্রদান করেছে জেলা প্রশাসন। যদি এই ১৪ টি শর্ত অমান্য করা হয় তাহলে অনুমতি বাতিল করা হবে। এ ব্যাপারে কোন অভিযোগ থাকলে জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করার আহ্বান জানান তিনি।
১৪ শর্তের মধ্যে ২ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, দক্ষতা সম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালককে দিয়ে প্যারাসেইলিং পরিচালনা করতে হবে। ৩ নম্বরে বলা হয়েছে, প্রতিকূল আবহাওয়ায় প্যারাসেইলিং পরিচালনা করা যাবে না। ৪ নম্বরে বলা হয়েছে, যাত্রী এবং চালকের জন্য লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক। ৭ নম্বর শর্তে বলা হয়েছে, কোন দুর্ঘটনা ঘটলে মালিক কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেন এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এদিকে আফসান জেবিন অদিতি কক্সবাজার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মকর্তা।
কক্সবাজার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পেশকার শাহজাহান নূরি জানিয়েছেন, আদালতে বিষয়টি আমলে নিয়ে এ ব্যাপারে একটি আদেশ প্রদান করবেন। আদেশটি প্রদান করা হলে জানানো হবে।