তারা এখন বাড়ির মালিক: লালমনিরহাটে হাজারো সুবিধাভোগীর স্বপ্নপূরণে আশ্রয়ণ-২
জীবনে প্রথমবারের মতো নিজের বাড়ির মালিকানা পেয়ে উচ্ছ্বসিত ৮৪ বছর বয়সী ফজল করিম।
অন্যের কৃষিজমিতে নিয়মিত কোদালের কাজ করা ফজল করিম বলেন, "শেষ সময়ে একটি স্থায়ী ঠিকানা আমার জীবনে পূর্ণতা দিয়েছে। আমার মতো এরকম অনেকের একটা বাড়ি, ঠিকানা হওয়ায় গ্রামে ঈদের আনন্দ চলছে।"
ব্রিটিশ আমলে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের জন্মগ্রহণ করেন ফজলে করিম। পাকিস্তান আমলে করেছেন বিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক হয়েছেন।
অথচ কখনও অনুভব করতে পারেননি নিজের একটি বাড়ি, একটি স্থায়ী ঠিকানা থাকার অনুভূতি। জন্মের পর জেনেছেন কালীগঞ্জের মহিষামুড়ি গ্রামের বাবার ভিটাটি সরকারের খাস জমি।
অতীতে নিজের বাড়ি কিংবা একটি ঘরের মালিকানার চেষ্টাও করেছেন বহুবার। গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের জমিতে দীর্ঘদিন বাস করার পর নিজের ছোটভাই মালিকানা পেলেও বাদ যান ফজল করিম। পরে 'গৃহায়ণ তহবিলের ঘর' নামক উদ্যোগেও চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি।
অবশেষে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় আধাপাকা এক কক্ষসহ ২ শতাংশের একটি ভিটের মালিকানা বুঝে পেতে যাচ্ছেন ফজল করিম। গত বৃহস্পতিবার নিরক্ষর এই ব্যক্তি ভূমি অফিসে প্রয়োজনীয় টিপ সই দিয়ে এসেছেন।
আগামীকাল মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরকম হাজারো সুবিধাভোগী মানুষকে তাদের প্রয়োজনীয় সনদ প্রদান করবেন।
কালীগঞ্জ এর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জহির ইমাম বলেন, "লালমনিরহাটে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর হস্তান্তর হবে মোট ১ হাজার ২৮২টি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি কালীগঞ্জ উপজেলায় ৮৭৫ টি, পাটগ্রামে ৯৯টি, হাতিবান্ধায় ১৬৬টি ও আদিতমারিতে ১৪২টি ভিটে হস্তান্তর হবে।"
প্রধানমন্ত্রী অনলাইন মাধ্যমে যুক্ত হয়ে কালীগঞ্জ উপজেলাকে ভূমিহীন এবং গৃহহীন মুক্ত উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করবেন।
ফজল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন সারাদিন মাঠে কোদালের কাজ শেষে নির্ভার মনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হই। এটা আমার জীবনের এমন একটা স্বপ্ন, যা পূরণ হতে হতে শেষ সময়ে চলে এসেছি।"
ফজল করিমের ছোট ভাই ৭৪ বছর বয়সী সাত্তার মিয়া বলেন, "ছোট বেলা থেকেই আমাদের যাযাবরের মতো জীবন। নদী ভাঙনের কারণে আমার বাবা সর্বশান্ত হয়। তখন থেকেই খাস জমিতে বসবাস। আমি গুচ্ছগ্রামে মালিকানা পেলেও সেসময় বঞ্চিত হয় বড়ভাই। পরে বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা তদবির করেও কাজ হয়নি। অবশেষে তার স্বপ্ন পূরণ হলো।"
ফজল করিমের মতোই নদী ভাঙনে সর্বশান্ত সুলতান মিয়া, আমেনা বেগম কিংবা ফজিলা খাতুনদের মতো আরও অনেকে। তাদের গল্পের ইতি ঘটতে চলেছে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের ২য় ধাপে ৭০টি উপজেলাকে ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত ঘোষণার মাধ্যমে।
১৯৭২ সালে সূচনা হওয়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে মোট ৪৬৪টি উপজেলা ভূমিহীন মুক্ত হতে যাচ্ছে।
মহিষামুড়ি গ্রামের তিন পুকুরের পাড়ে পুনর্বাসিত পরিবারগুলো সজ্জিত হয়েছে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ, নিরাপদ পানির জন্য নলকূপ, মসজিদ ও কবরস্থান স্থাপনের মাধ্যমে।
লাল টিন আর পাকা দেওয়ালের আধাপাকা বাড়িতেই গৃহস্থালীর সুন্দর ব্যবস্থা হয়েছে সুবিধাভোগীদের জন্য।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুলতান মিয়া ২ শতাংশ জমিতেই ৩টি ছাগল, ১টি ষাড় ও কয়েকটি মুরগী পালন করছেন। ঘাসও আবাদ হচ্ছে পুকুরের পাড়ে, সাথে রয়েছে সবজি বাগান। পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করছেন ২ ছেলে ও ২ মেয়েকে। সেইসাথে নিজে করেছেন ঝালমুড়ির দোকান।
এদিকে, ৬০ বছর বয়সে ভাবনাহীন জীবন-যাপনের সুযোগ পেয়েছেন রেজিয়া বেগম। তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করে ভরণপোষণ দিতে অস্বীকার করলে তিনিও আশ্রয় পান ২ শতাংশ ভিটেতে।
রেজিয়া বলেন, "আমি দৈনিক দুটির বেশি হাতপাখা বানাতে পারি। গ্রামবাসী থেকে শুরু করে বাইরের মানুষেও সেগুলো কেনে। এগুলো দিয়েই আমি চালিয়ে নিতে পারি। একাকী থাকি, রান্না করে খাই, ভাবনাহীন জীবন। মাঝে মধ্যে পাশের গ্রাম থেকে মেয়েরা দেখতে আসে, আমিও তাদের বাসায় যাই।"
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জহির ইমাম বলেন, "এই প্রকল্পে ঘর উপহার দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকা হয়নি, বরং তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রশিক্ষণমূলক বিভিন্ন কর্মসূচিও হাতে নেওয়া হয়েছে। তাদের দুই শতাংশ জমি দলিলের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়ে, তারমধ্যে সবজি চাষের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের বিষয়েও উৎসাহিত করা হচ্ছে।"