বগুড়ায় বছরে ২৭৩ কোটি টাকার জৈব সার উৎপাদনে নতুন ‘কৃষি বিপ্লব’
বগুড়ায় রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে জৈব সার ব্যবহার করে এক 'কৃষি বিপ্লবের' অংশ হয়েছেন সুরাইয়া ফারহানা রেশমা।
জৈব সার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করে দেশজুড়ে পরিচিত পেয়েছেন সংগ্রামী, সফল এই নারী। নিজ ফার্মে কেঁচো আর গোবর থেকে উৎপাদিত সার বিক্রি করে তিনি মাসে আড়াই লাখ টাকার ওপরে আয় করছেন। তার ফার্মে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে আরও ১৫ জনের।
প্রায় শূন্য থেকে ২ কোটি টাকা সম্পদের মালিক রেশমা এখন কৃষি বিপ্লবের জয়গান গাইছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় স্লোগান দিচ্ছেন। এর মধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকার ৭০০ জন উদ্যোক্তাকে জৈব সার তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। তারাও তৈরি করছেন জৈব সার। উৎপাদিত এসব সারের চাহিদা রয়েছে কৃষকদের কাছেও।
জাতীয় পর্যায়ে একাধিক পদক ও সম্মননা পাওয়া উদ্যোক্তা রেশমা জানালেন, "দেশের শত শত বেকার নারী-পুরুষ এখন জৈব সার তৈরির দিকে এগিয়ে আসছেন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও সহয়তাও বেড়েছে এ খাতে। সুযোগ হলে আগামীতে বড় পরিসরে কীটনাশকবিহীন কৃষি অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে সাধারণ কৃষকরা এসে ব্যাপকভাবে জৈব সার প্রয়োগের পদ্ধতি ও সুফল সম্পর্কে ধারণা পাবেন।"
বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বগুড়ায় বছরে গড়ে অন্তত ১ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টন জৈব সার উৎপাদিত হয়। প্রতি কেজি গড়ে ১৫ টাকা দরে ধরে জেলায় বছরে প্রায় ২৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকার জৈব সার উৎপাদিত হচ্ছে।
এই সার এসিআইসহ দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানেও বিক্রি হয়। বাণিজ্যিকভাবে বছরে কয়েক কোটি টাকার জৈব সার তৈরি করা হচ্ছে। এসব সার উৎপাদনে কর্মসংস্থানও হয়েছে অনেকের।
এনজিও থেকে প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা
বেসরকারিভাবেও উত্তরের কয়েকটি জেলায় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে জৈব সার তৈরির উদ্যোক্তাদেরকে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। তাদের উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মানও ভালো বলে জানিয়েছেন চাষীরা।
বগুড়ায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গ্রাম উন্নয়ন কর্মের (গাক) রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্টের (আরএমটিপি) মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে জৈব সার উৎপাদনের জন্য ৩০ জন উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা প্রতি মাসে অন্তত ১,৫৫১ টন কম্পোস্ট সার তৈরি করে বাজারজাতকরণ করছেন।
হিসাব বলছে, বছরে তারা ১১ কোটি ৬০ লাখ টাকার জৈব সার বিক্রি করেন। উদ্যোক্তারা গোবর সংগ্রহ করেন স্থানীয় ৭,০০০ জন খামারির কাছ থেকে।
এই প্রকল্পে অর্থায়ন করছে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ডানিডা। প্রকল্পের মাধ্যমে উৎপাদিত সার শুধু বগুড়াতেই ব্যবহার করেন প্রায় ২২,৬৭০ জন চাষী।
তাদের মধ্যে একজন হলেন শেরপুর উপজেলার জয়নব খাতুন। এই উদ্যোক্তা ১ বিঘা জমিতে সবজি চাষাবাদ করেছেন। জানালেন, "বিষমুক্ত সবজি ফলনে আমার কাছে জৈব সারের বিকল্প নেই। মানুষ এখন সুস্থভাবে বাঁচতে চায়।"
গাকের সিনিয়র পরিচালক ডা. মো মাহবুব আলম বলেন, "এখন রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের দৌরাত্বের কারণে ফসল বা দুধ-মাংস বিষে ভরপুর। এগুলো খেলে আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব পড়ে। এ কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আমরা নিরাপদ সবজি, মাছ-মাংস উৎপাদনে কৃষক বা খামারি পর্যায়ে কাজ করছি। এই প্রয়াসের অংশ হিসেবেই জৈব সার তৈরি ও ব্যবহারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। লক্ষ্য নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন।"
বিষমুক্ত খামার ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী হয়ে সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি দপ্তরে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর জৈব সার তৈরি করছেন সিরাজগঞ্জ সদরের শিয়ালকোল এলাকার রাশেদুল ইসলাম।
এই উদ্যোক্তা জানান, তার কারখানায় মাসে অন্তত ৫০ টন জৈব সার উৎপাদন হয়। এর বেশিরভাগই কিনে নেয় এসিআই কোম্পানি। গুণগতমান ভালো হওয়ার করণে স্থানীয়ভাবেও কিছু কৃষক জৈব সার কিনে ব্যবহার করছেন। আগামী বছর থেকে তার কারখানায় প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ২০০ টন জৈব সার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি।
স্মার্ট উদ্যোক্তারা তাদের উৎপাদিত সার নিজেদের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে, বড় ব্যবসায়ী এবং সরাসরি চাষীদের কাছে বিক্রি করেন বলে জানালেন রাশেদুল।
খামারীরা বলছেন, উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, নগদ আর্থিক সহায়তা, নেটিং মেশিন, কম্পোস্ট প্লান্ট তৈরি করার বিষয়ে সহায়তা করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)।
সংস্থাটির তথ্যমতে,পরিবেশ দূষণরোধে দেশে ৩৫২টি বাণিজ্যিক জৈব সার উৎপাদন কারখানা স্থাপন করা হবে। এরমধ্যে ১৭৪টি কারখানা সার উৎপাদন করছে। তারা মাসে প্রায় ৫ হাজার টন সার বিক্রি করছে। এতে কর্মসংস্থানও হয়েছে কয়েকশ মানুষের।
এই সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নমিতা হালদার বলেন, "নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট মানুষদের সাথে নিয়ে জীবনমান উন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ করণে উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিভিন্ন উপকরণ এবং প্রযুক্তি সহজলভ্যকরণ করা হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সংযোগ নিশ্চিতকরণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধির পদ্ধতিও তৈরি করা হয়েছে। সব মিলে কৃষক লাভবান হবেন। উদ্যোক্তা নিরাপদ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন পণ্য পৌঁছে দেবেন। রাসায়নিকের কবল থেকে রক্ষা হবে আমাদের জমিও।"
কৃষকদের পছন্দ জৈব সার
কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাটিতে বায়ু চলাচল, পানি ধারণক্ষমতা, সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা, উন্নত মাটির গঠনসহ বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে জৈব সার ব্যবহারে।
উত্তরাঞ্চলের কৃষি ও পরিবেশ নিয়ে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাহেদুল ইসলাম রাহি।
এই অধ্যাপক বলেন, "আগে খোলামেলা জায়গায় গোবর ফেলার করণে পরিবেশ দূষণ হতো। রাস্তার পাশে ফেলা গোবর থেকে মিথেন গ্যাস উৎপাদন হতো। গোরব আর বিষ্ঠা থেকে জৈব সার ব্যবহার করলে মিথেন উৎপাদন কমে। এটি ব্যবহারে মাটির গুণগত মান ঠিক থাকে। কৃষকের উৎপাদন খরচও কমে। নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার উপায় তৈরি হয়।"