বগুড়ায় নেই আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, লোকালয়েই ময়লার ভাগাড়
দেড়শ বছরের প্রাচীন হলেও আজও আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি বগুড়া পৌরসভায়।
ফলে মানুষের বাসা-বাড়ির বর্জ্য ফেলা হচ্ছে লোকালয়েই। পরে আবার এসবের বেশিরভাগই পৌরসভার গাড়িতে করে ফেলা হচ্ছে করতোয়া নদীতে।
আর এই করতোয়া নদীর কোলেই বগুড়ার শহরের বসতি। ফলে শহরের বর্জ্যের কারণে দূষণের প্রভাব পড়ছে বগুড়া পৌরবাসীর ওপর।
সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, আয়তনে দেশের বৃহত্তম বগুড়া পৌরসভায় প্রায় ১০ লাখ মানুষের বসতি। এই পরিমাণ জনবসতি থেকে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৩০০ টন ময়লা-আবর্জনা জমা হচ্ছে।
২০০৭ সালের আগে শহরের প্রতি মহল্লায় ডাস্টবিনে আবর্জনা ফেলা হতো। পরে পরিবেশ রক্ষায় সব ডাস্টবিন সরিয়ে দেওয়া হয়। ভ্যানের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ ডাস্টবিন চালু করে পৌরসভা। এ কাজের জন্য তখন গঠন করা হয় মহল্লাভিত্তিক কমিউনিটি বেইজ অর্গানাইজেশন (সিবিও)। এই সংগঠনের মাধ্যমে ভ্যানগাড়িতে করে ময়লা নিয়ে শহরের বিভিন্ন ট্রান্সফার স্টেশনে রাখা হয়। সেখান থেকে গার্বেজ ট্রাকে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ময়লা নিয়ে গিয়ে ফেলেন ভাগাড়ে।
বগুড়া শহরে ২০টি ট্রাক দিয়ে প্রতিদিন গড়ে একশ বার ময়লা আবর্জনা অপসারণ করা হয়। এসব ময়লা নিয়ে ফেলা হয় বগুড়া শহরের বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের ধারে বাঘোপাড়া এলাকায়। এর পাশেই করতোয়া নদী।
সম্প্রতি ঘুরে দেখা যায়, ট্রান্সফার স্টেশনগুলোর কয়েকটিতে শেড থাকলেও মোটাদাগে সেগুলো উন্মুক্ত। মোবাইল ডাস্টবিনে করে সিবিও শ্রমিকরা আবর্জনা নিয়ে এসে স্টেশনের সামনে ফেলছেন। এগুলোর বেশিরভাগই পড়ছে রাস্তার ওপরে।
বগুড়ার স্টেশন সড়কের পাশ দিয়ে সম্প্রতি নাকে কাপড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মারুফা আকতার রিনা নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি জানান, সড়কের অর্ধেক অংশজুড়েই কার্যত ময়লার ভাগার। পৌরসভার ময়লা-আবর্জনার কারণে এ পথে হেঁটে যাওয়া দুর্বিষহ।
"পচা গন্ধে বমি হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু কেউ এসব ময়লা ব্যবস্থানার দায়িত্ব নেয় না। স্যারেরা তো বড় বড় গাড়িতে চড়েন, সেখানে তো গন্ধ পৌঁছানোর কথা নয়," বলেন এই শিক্ষার্থী।
দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশগত, স্বাস্থ্য ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা
আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় এবং বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও ভাগাড়ে জমা করার পুরো প্রক্রিয়াটির কোনোটি সঠিকভাবে প্রতিপালিত না হওয়ায় বর্জ্যগুলো পুরো শহরের সড়ক, মহাসড়ক, অলিগলি, নদী-নালা, পুকুর, জলাশয়, কৃষিক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে এবং এতে ড্রেনেজ সিস্টেম জ্যাম হয়ে যাওয়ায় এ দূষণ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানান বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. আব্দুল হাই।
এই পরিবেশবিদ আরও বলেন, "পৌরসভার বর্জ্যের দূষণের মাধ্যমে মাটির উপকারী অনুজীব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্ষতিকর অনুজীব ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির আধার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিশুদ্ধ সুপেয় পানির প্রাপ্যতাও হুমকির মুখে পড়ছে।"
একইসঙ্গে, পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এটি নগরে মানুষের বসবাসযোগ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন বগুড়ার বাসিন্দা ও অনুসন্ধানী ক্রিডস নামে বেসরকারি সংস্থার পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মো. আতিকুর রহমান মল্লিক।
তিনি বলেন, "বর্জ্য কোথাও স্তূপ করে রাখলে সেখানকার মাটি, বাতাস দূষণ করবে। পানিতে মেশলে জলাশয়ের প্রাণবৈচিত্রে আঘাত হানবে। এগুলো এক-দুদিনে দেখা যায় না। এজন্য মানুষ এর প্রভাব বুঝতে পারে না। তবে দীর্ঘমেয়াদে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী প্রাণঘাতি রোগে আক্রান্ত হতে পারে।"
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বগুড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, "বগুড়ার মতো প্রাচীন পৌরসভার বর্জ্য রিসাইকেলিং ব্যবস্থাপনা চালু করতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা। ২০১৯-২০ সালের দিকে নেদারল্যান্ড থেকে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা এসেছিল বর্জ্য রিসাইকেল করার। কিন্তু পরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি।"
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক জানান, "এভাবে বর্জ্য দিয়ে নদী ভরাটের কারণে জনস্বাস্থ্য বিপন্ন হচ্ছে। এ ব্যাপারে একাধিক বার পৌর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে।"
শহরের বর্জ্য করতোয়া নদীতে ফেলার বিষয়টি সম্প্রতি জানতে পেরেছেন উল্লেখ করে বগুড়া পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মাসুম আলী বেগ বলেন, "ইতোমধ্যে সেখানে আবর্জনা ফেলতে নিষেধ করেছি। এসব আবর্জনা অন্য স্থানে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।"
এছাড়া, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের জন্য বড় ধরনের প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, "পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে আমরা কাজ করবো।"