তৃতীয় দেশে বাণিজ্যে বাংলাদেশ ও ভারত একে অপরের বন্দর ব্যবহার করতে চায়
পরস্পরের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানি করতে চায় বাংলাদেশ ও ভারত। এজন্য ভারতের কয়েকটি বন্দর পরিদর্শন ও বন্দরগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করতে বাংলাদেশের ১৬ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল শনিবার (৬ জুলাই) ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার বন্দর দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানি করে। এখন তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বন্দর ব্যবহার করতে চাইছে ঢাকা। অন্যদিকে একই উদ্দেশ্যে ভারত চাইছে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে।
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলটি তামিলনাড়ুর চেন্নাই, অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম ও কৃষ্ণপত্তনম এবং পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়াসহ কয়েকটি বন্দর পরিদর্শন করবে বলে বাংলাদেশের নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশ থেকে জানা গেছে। প্রতিনিধিদলের কলকাতার একটি বন্দরও পরিদর্শন করার কথা রয়েছে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এস এম মোস্তফা কামালের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলে নৌ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা রয়েছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ার বন্দর দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানি করে।
বাংলাদেশের সড়ক, রেলপথ, সমুদ্র ও নৌবন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি রয়েছে। নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানির জন্য বাংলাদেশকে বিনামূল্যে ট্রানজিট দিয়ে আসছে ভারত।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানি বা তৃতীয় দেশ থেকে আমদানি করা পণ্য নিজেদের দেশে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের। বিশেষ করে বাংলাদেশ চট্টগ্রাম বন্দরে যে বে টার্মিনাল তৈরি করছে, সেটি ব্যবহার করতে চায় ভারত।
সূত্রমতে, এ বিষয়ে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের সম্মতির পরই এই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গেছে বাংলাদেশি প্রতিনিধিদল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে নৌ-পরিবহন সচিব পর্যায়ের আলোচনায় বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর বিষয়ে সম্মত হয় উভয়পক্ষ।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল টিবিএসকে বলেন, ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রপ্তানি করতে চাচ্ছে। একইভাবে বাংলাদেশও ভারতের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রপ্তানির চিন্তাভাবনা করছে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে দুটি কমিটি কাজ করে। একটি সমুদ্রবন্দর-সংক্রান্ত, আরেকটি অভ্যন্তরীণ নৌবন্দর-সংক্রান্ত। এ বিষয়ে জয়েন্ট কমিটি আছে। যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে জয়েন্ট কমিটি সফর করে প্রতিবেদন দেয়। এরকম কোনো সম্ভাব্যতা আইনের আওতায় বা সংবিধানের আওতায় যদি সুযোগ থাকে, সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে যখন সচিব পর্যায়ের সভা হবে, তখন এটি এজেন্ডা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে।
মোস্তফা কামাল বলেন, এ সফর দ্বিপাক্ষিক। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ভারত সফর করছে। এরপর ভারতের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে। প্রতিটি বিষয় দ্বিপাক্ষিক।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ভারতকে যতটা সুবিধা দেবে, ভারত থেকেও সমপরিমাণ সুবিধা বাংলাদেশ নেবে।
নৌসচিব বলেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল দেশে ফিরে আসার পর ভারত বাংলাদেশে প্রতিনিধিদল পাঠানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠাবে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দুই দেশের সুবিধা অনুযায়ী সফরের দিনক্ষণ ঠিক হবে।
আর্থিক সুবিধার বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বন্দর চার্জ, ভ্যাট, ট্যাক্সসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা পাবে। ফলে এতে লোকসান নেই।
তবে এই কার্ক্রম খুব শীঘ্রই না-ও হতে পারে উল্লেখ করে মোস্তফা কামাল বলেন, যথাযথ ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ যে বে টার্মিনাল তৈরি করবে, তার ব্যবহার আগে থেকেই ঠিক করতে হবে।
তিনি বলেন, 'চট্টগ্রাম বন্দর মানে বর্তমান টার্মিনাল নয়। ২০২৭ সালে যখন বে টার্মিনাল তৈরি হবে, সেটাকে ব্যবহার করার লক্ষ্যে উভয় দেশ কাজ করছে। অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য। কেউ কাউকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নয়। এগুলো উইন উইন হবে প্রত্যেকটি।'
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভারতের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রপ্তানির প্রস্তাব করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণে এক দশক আগে বে টার্মিনাল প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য প্রতীকী মূল্যে ৫০১ একর জমি দেওয়ার প্রক্রিয়া গত মে মাসে চূড়ান্ত হয়েছে। গত ২৮ জুন প্রকল্পের ব্রেক ওয়াটার বা স্রোত প্রতিরোধক তৈরি এবং জাহাজ চলাচলের পথ তৈরি তথা খননকাজের জন্য ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পর্ষদ।
বিশ্বব্যাংকের নতুন এই ঋণ অনুমোদনের সুবাদে বে টার্মিনাল প্রকল্পের উন্নয়নকাজে গতি পাওয়ার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
বে টার্মিনালের প্রকল্প এলাকা চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনাল এলাকার চেয়ে বড়। বন্দর জলসীমার শেষ প্রান্তে চট্টগ্রাম ইপিজেডের পেছনের সাগরপার থেকে শুরু হবে বে টার্মিনাল প্রকল্পের সীমানা, যা গিয়ে শেষ হবে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের অদূরে রাসমণিঘাটে। বে টার্মিনালে মূলত জাহাজ থেকে কনটেইনার ও পণ্য ওঠানো-নামানো হবে।