ছেলের জন্য পিঠা নিয়ে এসে তার লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন মা
ছেলের পছন্দের পিঠাপুলি বানিয়ে সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন সায়মুনের মা রহিমা বেগম। বহদ্দারহাট এলাকায় দোকানের কাজ সেরে বৃহস্পতিবার রাতে চট্টগ্রাম নগরীর ফকিরহাট এলাকায় খালার বাসায় যাওয়ার কথা ছিল সায়মুনের; সেখানেই অপেক্ষায় ছিলেন মা। তবে শেষ পর্যন্ত মায়ের বানানো পিঠা আর খাওয়া হয়নি সায়মুনের।
এর আগেই বুকে-পিঠে গুলি খেয়ে না ফেরার দেশে চলে যেতে হয়েছে ১৬ বছরের সায়মুনকে। পিঠা নিয়ে ছেলেকে দেখতে এসে কফিনে বন্দি ছেলের নিথর দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন মা রহিমা বেগম।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বহদ্দারহাট এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিলে সংঘর্ষের আশঙ্কায় দুপুর ২টার দিকে দোকান বন্ধ করে সায়মুনকে ছুটি দিয়ে দেন মালিক মিঠু চৌধুরী।
দোকান থেকে বের হয়ে বাসায় যওয়ার পথে বহদ্দারহাট এলাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে চলমান সংঘর্ষে মাঝে পড়ে যায় সায়মুন; গুলিবিদ্ধ হয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গলিতে পড়ে থাকে সে।
পরে স্থানীয়রা অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকা সায়মুনকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বুকে ও পিঠে দু'টি গুলির চিহ্ন দেখা যায়। সাথে কোনো আইডি কার্ড বা মোবাইল ফোন না থাকায় তার পরিচয় প্রথমে শনাক্ত করা যায়নি।
শুক্রবার দুপুরে দোকানে না আসায় সায়মুনের মোবাইলে ফোন দেন মিঠু চৌধুরী। ফোনে তাকে না পেয়ে তার খালু মোহাম্মদ সুমনকে ফোন দিয়ে জানতে পারেন তার বাসায়ও যাননি সায়মুন। এদিক-সেদিক খুঁজে তার খোঁজ না পেয়ে পরদিন শনিবার চমেক হাসপাতালের মর্গে গিয়ে সায়মুনের মরদেহ শনাক্ত করেন দোকানের মালিক মিঠু চৌধুরী।
মিঠু টিবিএসকে বলেন, "প্রথমে আহতদের মাঝে তাকে খুঁজে না পেয়ে আমি ফিরে আসছিলাম। পরে হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির মুন্সি শাকিল বড়ুয়া তার মোবাইল ফোনে আমাকে একটি মরদেহের ছবি দেখায়। ছবিটি ছিল সায়মুনের। পরে মরদেহ শনাক্ত করার পর তার মা, খালা ও খালুকে খবর দিলে তারা এসে মরদেহ বুঝে নিয়ে যায়।"
সায়মুনের খালু মোহাম্মদ সুমন টিবিএসকে জানান, "সায়মুনের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর তখন ক্যানসারে মারা যায় বাবা আমিন রাসুল। মা রহিমা বেগম বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বড় ছেলে ও সায়মুনকে নিয়ে চালিয়ে যান জীবন সংগ্রাম। মাত্র ১০ বছর বয়সে দৈনিক ৩০ টাকা বেতনে একটি চায়ের দোকানে কাজ নিয়ে জীবন সংগ্রামে মায়ের সাথে যোগ দেয় সায়মুন। বছর তিনেক আগে গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপের বক্তার হাট এলাকা থেকে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে একটি মুদি দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে যোগ দেয়।"
তিনি বলেন, "করিতকর্মা ও চটপটে স্বভাবের কারণে সবাই তাকে পছন্দ করতো। মাস চারেক আগে পুরোনো চাকরি ছেড়ে বহদ্দারহাট মোড়ে হক মার্কেটে জয় এন্টারপ্রাইজ নামে একটি মুদি দোকানে যোগ দেয় মাসে ১৩,০০০ টাকা বেতনে। খতিবের হাট এলাকায় একটা মেসে থাকতো সায়মুন। মাসে এক দুইবার ছুটি পেলে আমাদের বাসায় আসতো। বৃহস্পতিবার রাতে তার আমাদের বাসায় আসার কথা ছিল। সকালে সন্দ্বীপ থেকে পিঠাপুলি নিয়ে এসেছিলেন তার মা। তার খালা ফ্রিজ থেকে গরুর মাংস বের করে রেখেছিলেন।"
সুমন বলেন, "বৃহস্পতিবার রাতে না আসায় আমারা ধরে নিয়েছিলাম বহদ্দারহাট গণ্ডোগোলের কারণে সে আসতে পারেনি। তার মোবাইলও বন্ধ ছিল। শুক্রবারেও সে না আসায় আমরা খোঁজাখুঁজি শুরু করি। পরে শনিবার বিকেলে চমেক হাসপাতালে তার মৃতদেহ পেয়ে দোকানের মালিক আমাদের খবর দেন।"
সায়মুনের মা বলেন, "আমার ছেলে পিঠা খুব পছন্দ করতো। তাই তার জন্য পিঠা বানিয়ে এনেছিলাম। সে পিঠা এখন কে খাবে?"
তিনি বলেন, "আমার ছেলে ছিল শান্তশিষ্ট। কারো সাথে কোনো ঝামেলায় যেতো না। মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজ করতো। তার বড়ভাই কোনো কাজ করতে পারে না। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সংসারের পুরো দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। আমাদের দেখার এখন আর কেউ রইলো না।"
তিনি বলেন, "আমি জানি না আমার ছেলেকে কে গুলি করেছে। আমি শুধু বিচার চাই। যারা আমার নির্দোষ ছেলেকে মেরে ফেলেছে, তাদের যেন বিচার হয়।"
তিনি আরও বলেন, "গতকাল (রোববার) প্রধানমন্ত্রী গণভবনে আমাদের ডেকে নিয়ে ৫০ হাজার টাকা নগদ ও ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। তিনি আমার ছেলেসহ যারা মারা গিয়েছে সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তেরও আশ্বাস দিয়েছেন।"
উল্লেখ, বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) চট্টগ্রামে শাহ আমানত সেতু, কালামিয়া বাজার, বহদ্দারহাট ও মুরাদপুর এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সময় সংঘর্ষে দুইজন নিহত ও ৫২ জন আহত হয়ে চমেক হাসপাতালে ভর্তি হন। আহতদের ৩৩ জন ছিল গুলিবিদ্ধ, এরমধ্যে আহত ছিলেন ৮ জন পুলিশ।