গৃহপরিচারিকা মাকে অবসর দেওয়া হলো না হৃদয়ের
ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে গৃহপরিচালিকার কাজ করতেন মা অর্চনা রানী। দুই বছর পর পড়াশোনা শেষ করে মাকে অবসর দেওয়ার কথা ছিল তার। এর আগেই বুলেট কেড়ে নিল বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলের প্রাণ। পরিবারের হাল ধরার স্বপ্ন পূরণ হলো না কারোরই।
সোমবার (২৯ জুলাই) সকালে মুঠোফোনে ছেলেকে নিয়ে ধূসর হওয়া স্বপ্নের কথা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়ার বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া।
গত ১৮ জুলাই চট্টগ্রাম নগরীর বহাদ্দারহাটে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আন্দোলনকারী এই শিক্ষার্থী। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
হৃদয়ের বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া বলেন, 'আমার ছেলে পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বুঝত না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল, তখন আমরা এতদূরে দিতে চাইনি। কিন্তু ছেলে বলেছিল, এখানে সবাই পড়ার সুযোগ পায় না। চিন্তা না করতে। পরে ওর মা মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করে (গৃহপরিচারিকা) বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা জোগাড় করেছিল। কিন্তু আমার ছেলেটি তো লাশ হয়ে ফিরল।'
হৃদয়ের বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঘটকের আন্দুয়া গ্রামে হলেও শহরের মুন্সেফপাড়া এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন দীর্ঘদিন। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা রতন চন্দ্র পেশায় কাঠমিস্ত্রি। পরিবার চালাতে মা অর্চনা রানী মানুষের বাসায় টুকটাক গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন।
অদম্য এই মেধাবী পটুয়াখালী থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ অর্জন করে চট্টগ্রাম বিশ্বিবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তার সহপাঠীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান, মানবিক মানুষ হৃদয় তরুয়া শুরু থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন সক্রিয় ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের হাল ধরাই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। 'পৃথিবীটা হোক মনুষ্যত্বের, এটাই আমার প্রত্যাশা'—ফেসবুকের বায়োতে এমন কথা লেখা ছিল হৃদয়ের। কিন্তু অমানবিক বুলেট কেড়ে নিল এই তরুণ প্রাণ।
মৃত্যুর পর সহপাঠীরা হৃদয়ের হাতে লেখা ডায়েরির দুটি পেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। তার সেই নোটেও দারিদ্র্য, পরিবারের ওপর পড়ালেখার ব্যয়ের চাপ কমানোর বিষয়টি ফুটে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথমদিককার এক নোটে হৃদয় উল্লেখ করেছিলন—আগে বাড়িতে থেকে (পটুয়াখালীতে পরিবারের সঙ্গে) পড়াশোনা করায় পরিবারের ওপর আর্থিক চাপ পড়ত না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা বাড়ি থেকে আনতে হতো। চট্টগ্রামে নতুন আসায় টিউশনিও পাচ্ছিলেন না।
পরে অবশ্য হৃদয় টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ জোগানো শুরু করেছিলেন হৃদয়। তার বাবা রতন চন্দ্র বলেন, 'প্রায় দেড় বছর ধরে বাসা থেকে কোনো খরচ নিত না। টিউশনি করে চলত। আমাদের মাঝে মাঝে টাকা পাঠাতে চাইত। কিন্তু আমি বলতাম, দরকার নেই। কষ্ট যেন না করে। তখন ছেলে বলত, চাকরি নিয়ে পরিবারের দুঃখ-কষ্ট (দরিদ্রতা) দূর করবে।'