দেশে সর্বপ্রথম কিং কোবরার ডিম থেকে কৃত্রিম উপায়ে ফুটল ২৫টি বাচ্চা
কিং কোবরা বাংলাদেশে পাওয়া সাপের জাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিষধর। এটি একটি অতি বিপন্ন সাপের প্রজাতি। ম্যানগ্রোভ ও রেইন ফরেস্টের গভীর বনে এদের আবাস। লোকালয়ে এদের দেখা মিলে না বললেই চলে। কৃত্রিম উপায়ে বাংলাদেশে কিং কোবরার ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা জন্মানোর কোন রেকর্ডও ছিল না।
তবে দেশে প্রথমবারের মত কৃত্রিম উপায়ে কিং কোবরার ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর বিরল কাজটি করে দেখিয়েছেন চট্টগ্রামের স্নেক রেসকিউয়ার সিদ্দিকুর রহমান রাব্বি। তিনি বাংলাদেশ স্নেক রেসকিউ টিমের একজন সদস্য ও চট্টগ্রাম স্নেক রেসকিউ টিমের প্রধান।
এক মাসের কিছু বেশি সময় ডিমগুলোকে একটি বক্সের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে বানানো বাসায় নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় রাখার পর জুলাই মাসের ২২ তারিখ ডিমগুলো ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে বলে জানিয়েছেন রাব্বি।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মত কৃত্রিম উপায়ে কিং কোবরা ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে সাপ বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, "কিং কোবরা একটি অতিথি বিপন্ন প্রাণী। বাংলাদেশে এর আগে কখনোই কৃত্রিম উপায়ে এর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর কোন রেকর্ড নেই। রাব্বিই প্রথম ব্যক্তি যে কাজটি করে দেখিয়েছেন।"
ওয়াহেদ চৌধুরী আরও বলেন, "কিং কোবরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বিষধর সাপ হলেও এর দংশনে মানুষের মৃত্যুর তেমন কোন রেকর্ড নেই। এরা সাধারণত অন্য সাপ খেয়ে বেঁচে থাকে। অন্যান্য বিষধর সাপ খেয়ে এরা প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। তাই প্রকৃতি খাদ্য শৃঙ্খলের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাণী কিং কোবরা।"
সদ্য ফোটা বাচ্চাগুলোকে একটু সময় নিয়ে আরো বড় করে তারপর প্রকৃতিতে অবমুক্ত করার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। বিলুপ্তপ্রায় এই সাপ সংরক্ষণ করা গেলে দেশে জীববৈচিত্র্য আরো সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করেন তিনি।
ডিম সংগ্রহ ও বাচ্চা ফোটানো হয় যেভাবে
গত ২০ জুন বান্দরবানের এক দূর্গম এলাকা থেকে একটি বিরল প্রজাতির কিং কোবরা উদ্ধারে খবর পেয়ে সেখানে ছুটে রাব্বি ও তার টিম। গিয়ে দেখেন বেশ বড় একটি কিং কোবরা উদ্ধারের পাশাপাশি ২৫টি ডিমও উদ্ধার করেন এক আদিবাসী যুবক। প্রতিটি কিং কোবরার ডিমের বদলে চারটি করে মুরগীর ডিম দিয়ে তার কাছ থেকে ডিমগুলো কিনে নেন রাব্বি। সাপটি কিনে নিয়ে বনে অবমুক্ত করে দিয়ে চলে আসেন চট্টগ্রামে।
রাব্বি বলেন, "ডিমগুলো বাড়িতে এনে দেখতে পেলাম ওগুলো প্রচুর ফাঙ্গাসে আক্রান্ত। প্রথমে ডিমগুলোকে ফাঙ্গাসমুক্ত করি। গত কয়েক বছরে হাজারের ওপর সাপ উদ্ধারের অভিজ্ঞতা থাকলেও সাপের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর কোন অভিজ্ঞতা আমার ছিলো না। অনলাইনে ঘেটে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করি। পরে একটি প্লাস্টিকের বাক্সে বাঁশপাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিমগুলোকে সেখানে রেখে দেই। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে অপেক্ষা করতে থাকি। অবশেষে গত ২২ জুলাই ডিমগুলো ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে।"
সাপের বাচ্চাগুলো যা যাচ্ছে
প্রথম এক সপ্তাহে সাপের বাচ্চার কোন খাবারের প্রয়োজন হয় না। এক সপ্তাহ পর থেকে বাচ্চাগুলো মুরগীর মাংস ছোট ছোট পিস করে খেতে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া তাদের পর্যাপ্ত পানিও দেয়া হচ্ছে। সবগুলো বাচ্চাই সুস্থ ও সবল ভাবে বেড়ে উঠছে।
রাব্বি বলেন, "কিং কোবরার প্রধান শিকার হচ্ছে বিভিন্ন বিষধর প্রজাতির সাপ। তবে তিন মাস বয়সের আগে তারা সাপ শিকার করতে পারে না। তারা যেহেতু মাংসাশী প্রাণী আপাতত তাই মুরগীর মাংস খাইয়ে বড় করছি। বাচ্চাগুলো একটু পরিপক্ব হলে আমরা প্রকৃতিতে অবমুক্ত করবো।
প্রকৃতির সাথে খাপ খাওয়ানো হচ্ছে যেভাবে
স্নেক রেসকিউ টিমের আরেক সদস্য দেবাশীষ জানান, বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য চট্টগ্রামের বাটালী হিলের শতায়ু অঙ্গনে নিয়ে আসি। তাদের প্রকৃতিতে ছেড়ে দিই। সেক্ষেত্রে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর আবারও বাক্সে ভরে বাসায় নিয়ে যাই।
টিমের অন্য এক সদস্য অর্ণব বলেন, "ইতোমধ্যে আমরা খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা এলাকায় পিঠাছড়া রিজার্ভ ফরেস্টে পাঁচটি বাচ্চা অবমুক্ত করেছি। আমাদের কাছে বর্তমানে ২০টি বাচ্চা আছে। পাঁচটি করে বাচ্চা চট্টগ্রামের আরো চারটি রিজার্ভ ফরেস্টে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিকল্পনা করছি আমরা।"
কিং কোবরার মত বিলুপ্ত প্রায় সাপের ডিম থেকে কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চা ফুটিয়ে তাদের প্রকৃতিতে অবমুক্ত করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সাপ বিশেষজ্ঞরা।