রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা যেভাবে চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে সাবাড় করেছেন
চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার অন্তর্গত চন্দ্রনগর কলাবাগান এলাকায় প্রায় ২০ ফুট উঁচু টিনের ঘেরা দিয়ে কাটা হচ্ছিল একটি পাহাড়। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গত বছরের ২৩ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের দুটি টিম অভিযান পরিচালনা করে দেখতে পায় প্রায় ৩ একরজুড়ে বিস্তৃত পাহাড়ের প্রায় ১৫,০০০ বর্গফুট কেটে ফেলা হয়েছে।
তবে, ঘটনাস্থলে কাউকে না পেয়ে ফিরে আসেন টিমের সদস্যরা। তদন্তে পাহাড়টি কাটার ঘটনায় অ্যাডভোকেট হেলাল বিন মনজুর তামিম ও আরিফুল ইসলাম নামে দুই ব্যক্তির সম্পৃক্ততা পায় পরিবেশ অধিদপ্তর।
এ ঘটনার এক বছর পার হয়ে গেলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসন। এমনকি, এই ঘটনায় হয়নি কোনো মামলাও।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অ্যাডভোকেট হেলাল বিন মনজুর তামিমের সাথে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে বিশেষ সখ্য থাকায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।
তবে, আওয়ামী সরকারের পতন হলেও থামানো যায়নি অ্যাডভোকেট হেলাল বিন মনজুর তামিম ও আরিফুল ইসলামকে। সরকার পতনের পর অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে থানার পুলিশের কার্যক্রম বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়ে দিনে-রাতে কাটা হয়েছে পাহাড়টির বেশ কিছু অংশ।
বিষয়টি স্বীকার করে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, "নানান কারণ ও রাজনৈতিক চাপে এতদিন ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি তাদের বিরুদ্ধে। তবে পাহাড় কাটা বন্ধ ছিল এতদিন। সম্প্রতি তারা আবারও পাহাড় কাটা শুরু করলে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হচ্ছে।"
এ বিষয়ে জানতে তামিম ও আরিফুলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, শুধু তামিমই নন, গত ১৫ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতা পাহাড়তলী ও বায়েজিদ এলাকায় পাহাড় কেটে সাবাড় করায় নেতৃত্ব দিলেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা এলাকার পরিমাণ ছিল ৬৭৯ হেক্টর। আর ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১,২৯৫ হেক্টরে। পাহাড় কাটা নিয়ে 'হিল কাটিং ইন অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি' নামের একটি গবেষণায় গুগল আর্থের ছবি বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবছর যে হারে পাহাড় নিধন চলছে তাতে চট্টগ্রাম শহরে পাহাড় কাটা এলাকা বেড়ে এখন দুই হাজার হেক্টর হয়েছে বলে মনে করেন গবেষণা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে ২০১২ সালের পর আর গবেষণা হয়নি বলে পাহাড় কাটা এলাকার প্রকৃত তথ্য জানা যায়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম মহানগরে পাহাড় কাটার ঘটনায় ২০০৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ বছরে ৯০টি মামলা করা হয়েছে। ২০২৪ সালে মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম জেলয়া পাহাড় কাটা ঘটনায় গত এক বছরে (জুন ২০২৩-জুন ২০২৪) পরিবেশ আদালতে ১২টি মামলা দায়েরের পাশাপাশি ২১টি এনফোর্সমেন্ট মামলায় ৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "পাহাড় কাটায় অভিযুক্তরা হয় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বা কোনো প্রভাবশালীর আশীর্বাদপুষ্ট। রাজনৈতিক চাপের কারণে চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এই সুযোগে পাহাড় কেটে সাবাড় করেন তারা। অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের করার কিছুই থাকে না।"
পাহাড় কাটাদের দলের একজন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৯ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা জহুরুল আলম জসিম। তার বিরুদ্ধে পাহাড়তলী এলাকায় অন্তত ২০টি পাহাড় কাটার ঘটনায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে ৩টি। তারমধ্যে একটি মামলায় তার বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। তারপরও থামানো যায়নি তার পাহাড় কাটা।
জহুরুল আলম জসিম পাহাড়তলী এলাকায় এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে গত বছরের ১২ জুন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের (বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা) নেতৃত্বে পরিবেশবাদীদের একটি দল ওই এলাকা পরিদর্শনে গেলে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়।
এই ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ জহুরুল আলম জসিমকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দিলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ বছরের ২৪ জানুয়ারি তাকে কাউন্সিলর পদ থেকে বরখাস্তের আদেশ জারি করে। তবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই উচ্চ আদালতে রিট করে পদ ফিরে পান তিনি।
এ বিষয়ে জহুরুল আলমের মন্তব্যের জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
শুধু জহুরুল আলম জসিমই নন, বায়েজিদের চন্দ্রনগর এলাকায় নাগিন পাহাড়সহ অসংখ্য পাহাড় কাটায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ আছে জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বাহার উদ্দিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন বিরুদ্ধে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ পাওয়ায় চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি একটি মামলা করা হয়।
মামলার পর কয়েক দিন চুপচাপ থাকলেও ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে পুনরায় তারা পাহাড় কাটা শুরু করেন। কিন্তু তা নজরে আসেনি পরিবেশ অধিদপ্তরের। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ ও মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস এলাকাটি পরিদর্শন করে পুনরায় পাহাড় কাটার অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পান। পরে তাদের শুনানিতে ডেকে পাঠায় পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই মামলায় এখনো চার্জশিট দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, "পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে বা মামলা করে কোনো লাভ হয় না। গত ২০ বছরে ৯০টি মামলা করলেও কাউকে বড় কোনো সাজা দেওয়া হয়নি।"
তিনি বলেন, "সব হুমকি ধামকি উপেক্ষা করে প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি জহুরুল আলম জসিমের বরখাস্ত করার সুপারিশ করেছিলাম আমি। তবে, উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ এনে তিনি আবার স্ব-পদে বহাল হন। পাহাড় খেকোদের কঠোর সাজা দিতে না পারলে পাহাড় কাটা বন্ধ করা যাবে না।"
এর আগে, আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসন এ বছরের শুরুর দিকে নগরের পাহাড়ি ২৬টি স্থানকে চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড দিয়েছিল। এর মধ্যে ১৬টি ছিল উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে। চিহ্নিত স্থানের মধ্যে হারবাতলী, জয়ন্তিকা উত্তর লেক সিটি, বিজয় নগর, গাউছিয়া লেক সিটি (নাইচ্চাঘোনা) এলাকায় সড়ক নির্মাণের নামে পাহাড় কাটা চলছে।
পাহাড় কাটা রোধে হটলাইন ও স্ট্রাইকিং ফোর্স চালুর দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা রোধে দীর্ঘদিন ধরে একটি হটলাইন চালু ও একটি ডেডিকেটেড স্ট্রাইকিং ফোর্স চালু করার দাবি জানিয়ে আসছে তারা। কোনো জায়গায় পাহাড় কাটা হলে যাতে স্থানীয়রা ওই হট লাইন নম্বরে কল করে অভিযোগ দিতে পারে এবং স্ট্রাইকিং ফোর্স সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে পারে। এই ব্যবস্থা চালু করা না গেলে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোকে রক্ষা করা যাবে না মনে করছেন বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান।
পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়ক মনিরা পারভিন রুবা অভিযোগ করে বলেন, "পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে যে আইনি ব্যাবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা খুবই নগণ্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জরিমানা করে জায়েজ করা হচ্ছে পাহাড় কাটার মত অপরাধ। আবার মামলা করা হলে অপরাধীরা পার পেয়ে যান আইনের ফাঁক গলে। যে কারণে চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
"এমনটা চলতে থাকলে আগামী ১০ বছর পর চট্টগ্রামে কোনো পাহাড়ই থাকবে না," যোগ করেন তিনি।