লন্ডনে টিউলিপের ব্যবহৃত ফ্ল্যাটটি একটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা হয়: সানডে টাইমস
লন্ডনের হ্যাম্পস্টেডে ব্রিটিশ সিটি মিনিস্টার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিক যে ফ্ল্যাটে কয়েক বছর বসবাস করেন, সেটি পেডরক ভেঞ্চারস নামে একটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দুজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সানডে টাইমসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
৪২ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ এমপি ফ্ল্যাটটিতে বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছেন। ২০১২ ও ২০১৪ সালে নিজের ঠিকানা হিসেবে তিনি এই ফ্ল্যাটের উল্লেখ করেছিলেন।
টিউলিপ এমপি হওয়ার পরের বছর ২০১৬ সালে তার স্বামী ক্রিশ্চিয়ান পার্সিও নিজের ঠিকানা হিসেবে ফ্ল্যাটটির উল্লেখ করেছিলেন।
পরবর্তীতে টিউলিপ সিদ্দিকের বোন আজমিনা ওই ফ্ল্যাটটি ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করেন।
সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে জানা গেছে, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে নিবন্ধিত পেডরক ভেঞ্চারস নামের একটি অফশোর কোম্পানি ২০০০ সালে ২ লাখ ৪৩ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে এই ফ্ল্যাটটি কিনেছিল।
ফাঁস হওয়া পানামা পেপারস এবং ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টসের (আইসিআইজে) সরবরাহ করা নথিতে দেখা যায়, হারবার্টন এস এ নামে একটি অফশোর কোম্পানি পেডরক ভেঞ্চারস কিনে নেয়। এরপর পেডরক ভেঞ্চারস বন্ধ হয়ে যায়।
ওই প্রতিষ্ঠানের দুই শেয়ারহোল্ডার ছিলেন বাংলাদেশের দুই ভাই নাসিম আলী ও মাসুদ আলী। তারা যৌথভাবে ১৯৮৩ সালে ঢাকায় নিবন্ধিত শ্যামলিমা লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির মালিক। এটি দেশে কর্মরত বিদেশি জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলোকে লজিস্টিক ও জনবল সরবরাহ করে।
শ্যামলিমা লিমিটেড নিজেদেরকে 'দীর্ঘ অভিজ্ঞতা' সম্পন্ন বাংলাদেশের 'নেতৃস্থানীয় একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাদের 'প্রকল্পগুলোতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মীর কাছ থেকে ঘনিষ্ঠ ও পূর্ণ সহযোগিতা' পাওয়া যায়, যা 'বড় ধরনের সাহায্য' করে থাকে বলেও উল্লেখ করেছেন তারা।
শ্যামলিমার ক্লায়েন্টদের মধ্যে ছিল- শেভরন, শেল এবং চীনা রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো। তাদের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং সৌরশক্তির ব্যবসাও রয়েছে।
তাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, তারা 'বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেছে'।
সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ৭০ বছর বয়সী নাসিম আলী ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি একজন শিল্পীকে বিয়ে করেন এবং তার সন্তানদের উত্তর লন্ডনের একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেন। শুধুমাত্র তিনি মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসেন।
এদিকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া দলিল অনুযায়ী, তার ভাই মাসুদ আলী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
ব্যবসায়িক অংশীদার শহীদ ইনাম চৌধুরীর সঙ্গে মিলে পেডরক এবং হারবার্টন এসএ ছাড়াও নাসিম আলী ও মাসুদ আলী ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম শ্যামলিমা।
ফ্ল্যাটটি টিউলিপ সিদ্দিকের বোনের কাছে কীভাবে গেল
২০০৫ সালের জানুয়ারিতে নাসিম আলী ও মাসুদ আলী হারবারটন এসএ-বন্ধ করে দেওয়ার আবেদন করেন। এর ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে হ্যাম্পস্টেডের ফ্ল্যাটটি উপহার হিসেবে বাংলাদেশের আইনজীবী মঈন গনির কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেসময় মঈন গনির বয়স ছিল ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। পরবর্তীতে তিনি শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন।
সানডে টাইমসের প্রতিবেদনের অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ছবিও আছে। এছাড়া, একবার শেখ হাসিনা তাকে একটি আন্তর্জাতিক প্যানেলে কাজ করতে আমন্ত্রণ জানান। মঈন গনি এটিকে 'ব্যক্তিগত সম্মান' বলে বর্ণনা করেছিলেন।
ঢাকার একটি সূত্র অনুযায়ী, গনির বাবা-মা টিউলিপ সিদ্দিকের মায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একসময় তারা একটি রেঁস্তোরা দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিয়মিত সেখানে যেতেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে সানডে টাইমসের প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য নাসিম আলী, মাসুদ আলী ও মঈন গণির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও, তারা কেউই ব্রিটিশ পত্রিকাটির অনুরোধে সাড়া দেননি।
দ্য সানডে টাইমস ঢাকায় তাদের দুটি কার্যালয়ে যোগাযোগ করেছে। কার্যালয়ের কর্মীরা বলেছেন, দুই পরিচালক কোথায় আছেন এ বিষয়ে তারা কিছু জানাতে এবং মোবাইলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবেন না।
পরে একটি সূত্র ব্রিটিশ সংবাদপত্রটিকে জানায়, পরিচালকেরা 'এ বিষয়ে' জানতেন না
পত্রিকাটি মঈন গনির কার্যালয়ে গিয়েও একই রকম প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। সেখানকার কর্মীরা জানান, গত বছর থেকে তিনি লন্ডনে রয়েছেন।
উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের সার্কেলউড এলাকায় নাসিম আলীর বাড়িতে গিয়ে দরজায় কড়া নেড়েও কাউকে পাওয়া যায়নি।
ক্ষমতাচ্যুতির প্রায় চার মাস পর গত ১৭ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে ৮০ হাজার কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে।
পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপও রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শুরু হওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ৮০ হাজার কোটি টাকার অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের মধ্যে ৫৯ হাজার কোটি টাকা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এই হাই প্রোফাইল তদন্তে টিউলিপের জড়িত থাকার খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়ে উঠেছেন ব্রিটিশ এই মন্ত্রী।
টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ওঠা বর্তমানের কথিত অভিযোগ, তার অতীতের অনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং যুক্তরাজ্যের কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের খবর দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, ডেইলি মেইল, ফিনান্সিয়াল টাইমস, দ্য টেলিগ্রাফ এবং সানডে টাইমসসহ বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ মিডিয়া আউটলেটের নিয়মিত সংবাদ হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির নেতা কেমি ব্যাডেনোচ দুর্নীতির অভিযোগে টিউলিপকে বরখাস্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের প্রতি আহ্বান জানান।
সানডে টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'টিউলিপের লন্ডনের সম্পত্তি নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্তে যদি প্রমাণ হয়, তিনি 'প্লেইন (সরাসরি) ডাকাতি'র সুবিধাভোগী, তাহলে সম্পত্তিগুলো ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।'
টিউলিপের দুর্নীতি নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই মন্তব্যের পরই কনজারভেটিভ পার্টির নেতা কেমি ব্যাডেনোচ এই মন্তব্য করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে ব্যাডেনোচ বলেন, প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের উচিত টিউলিপ সিদ্দিককে বরখাস্ত করা। প্রধানমন্ত্রী তার ব্যক্তিগত বন্ধুকে দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেছেন, অথচ তিনি নিজেকেই দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত।