আওয়ামী লীগের আমলে যেভাবে মন্ত্রী বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেত প্রকল্পের গুরুত্বও
রাজধানীর বেইলি রোডে পরিকল্পিত ৩৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ের বিশাল সার্কিট হাউস প্রকল্পটি প্রথমে কম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছিল। ফলে ২০২২ সালে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী প্রকল্পটি ফেরত পাঠান।
কিন্তু দেড় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আরেক পরিকল্পনামন্ত্রীর তাগাদায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হয় এবং অনুমোদন দেওয়া হয়।
একটি প্রকল্পের অগ্রাধিকার কীভাবে ব্যক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়, তার একটি উদাহরণ এ প্রকল্প। প্রকল্পের গুরুত্ব বিচেনায় কিংবা বিভিন্ন ব্যয় নিয়ে আপত্তির কারণে পরিকল্পনা কমিশন একনেক সভায় যে প্রকল্প উপস্থাপন না করে ফেরত দেয়, সেই প্রকল্পই আবার বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে একনেকে উপস্থাপন হয়—এবং অনুমোদনও পেয়েছে।
মন্ত্রী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের গুরুত্বও বদলে গেছে এবং বেশি ব্যয়ে অনুমোদন পেয়েছে প্রকল্প।
এমন একটি প্রকল্প বেইলী রোড পুরাতন সার্কিট হাউজের জায়গায় ৫ তারকা মানের থাকা-খাওযয়ার ব্যবস্থাসহ সার্কিট হাউজ নির্মাণ প্রকল্প।
এ প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন বেশ কয়েকবার আপত্তি তোলে। এমনকি প্রকল্পটি নিয়ে জনপ্রশসন মন্ত্রণালয়ও খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তারপরও প্রকল্পটির অনুমোদন ঠেকানো যায়নি।
আপত্তির পরও অনুমোদন
এ প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয় ২০২২ সালের ৫ মে। ওই বছরের নভেম্বরে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপন প্রস্তাব ফেরত দেন।
দুবছর পর, ২০২৪ সালে নতুন পরিকল্পনামন্ত্রী হন মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম। তিনি মন্ত্রী হওয়ার পর প্রকল্পটির ভাগ্যও বদলে যায়।
২০২৪ সালের ২ এপ্রিল আব্দুস সালাম আবার এই প্রকল্পটি পরবর্তী একনেক সভায় উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। পরে ৯ এপ্রিল প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপন করা হয় এবং অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রস্তাব অনুযায়ী, এ প্রকল্পের আওতায় ১৩তলা একটি ও আটতলা একটি ভবন নির্মাণ করা হবে। জেলা প্রশাসনের অধীনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এটা পরিচালনা করা হবে।
সার্কিট হাউজের জন্য বিলাসবহুল বিভিন্ন উপকরণ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য থেকে সংগ্রহ করা হবে বলে প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে উচ্চ ব্যয়ে এই বিলাসবহুল সার্কিট হাউজ নির্মাণ প্রকল্পে বেশ কিছু আপত্তি তোলে পরিকল্পনা কমিশন।
কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার বাইরে থেকে যেসব কর্মকর্তারা আসবেন, তাদের বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে এ সার্কিট হাউজ ব্যবহার করতে হবে। ফলে এটি সরকারি কর্তকর্তাদের কোনো কাজে আসবে না বলে এই প্রকল্পে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি ছিল।
২০২২ সালে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য ছিলেন মামুন-আল-রশীদ।
তিনি টিবিএসকে জানান, বিলাসী এ প্রকল্পের বিশাল অঙ্কের ব্যয় নিয়েও আপত্তি ছিল। এ কারণেও প্রকল্পটি ওই সময় একনেকে উপস্থাপন করা হয়নি।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি দ্রুত একনেক উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করতে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম ভৌত অবকাঠামো বিভাগের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে।
কর্মকর্তারা বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পটি ডেলিগেটড ওয়ার্ক হিসাবে গণপূর্ত অধিদপ্তরের বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। কিন্ত প্রকল্পটি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। বিশেষ গোষ্ঠী এই প্রকল্পের অনুমোদন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে।
গত ৫ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা বিভাগের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে পাঠানো এক চিঠি থেকে জানা যায়, সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে মূল ডিপিপি ও একনেক সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে প্রকল্পের নির্দিষ্ট কিছু অংশের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল পরিবর্তন করা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, যেহেতু প্রকল্পটি একনেক অনুমোদন করেছে, তাই সভার সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো পরিবর্তন করা যাবে না।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে মাঠ প্রশাসন থেকে আগত কর্মকর্তাদের ঢাকায় সাময়িক অবস্থানকালীন সুবিধা বাড়ানোর জন্য বহুতল সার্কিট হাউজ ভবন ও ডরমিটরি নির্মাণের নির্দেশ দেন। সেই অনুযায়ী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
একনেক সভায় জনপ্রশাসন সচিব বলেন, মাঠ পর্যায় থেকে ঢাকায় আগত সরকারি কর্মকর্তাদের সাময়িক অবস্থানের জন্য সার্কিট হাউজটি খুব বেশি ব্যবহৃত হবে না। এ কারণে বিশাল অবকাঠামো নির্মাণের যৌক্তিকতা আছে কি না, সে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। তবে নির্মিতব্য সার্কিট হাউজটি বিদেশি ডেলিগেটদের অবস্থান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনার ও কনফারেন্স আয়োজনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে বলে তিনি মতামত দেন।
প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে
অনুমোদন পেলেও প্রকল্পটি এখনও পরিকল্পনা কমিশনের একনেক শাখা থেকে সরকারি আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে। এই আদেশ ছাড়া প্রকল্প নিয়ে এগোনো যাবে না।
কর্মকর্তারা ইঙ্গিত বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারি আদেশ জারি করা হবে কি না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তারা আরও বলেন, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ঠিক আগে শুরু হওয়া প্রকল্পগুলো এবং যেগুলো এখনও শুরু হয়নি, সেগুলো বাতিল হতে পারে। আবার যেসব প্রকল্প এখনই প্রয়োজনীয় নয় বা অগুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে, সেগুলোও বাতিল হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার এটিসহ আরও অনেক প্রকল্প পর্যালোচনা করে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তবে কর্মকর্তারা বলছেন, বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার প্রতিটি প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, রাজনৈতিক বা গোষ্ঠী স্বার্থে নেওয়া প্রকল্পগুলো বাতিল করা হবে।
অধিক ব্যয়ের আরেকটি প্রকল্প
এ ধরনের আরেকটি প্রকল্প হলো, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর প্রকল্প। এ প্রকল্পের প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা হয় ২০১৮ সালের ১২ জুলাই ।
ওই সময় রেলওয়ে প্রকল্প প্রস্তাবে ২৩৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় প্রস্তাব করেছিল ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। এ ব্যয় প্রস্তাবকে অস্বাভাবিক বলে আপত্তি জানিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন।
জিটুজি পদ্ধতিতে চীন সরকার এ প্রকল্পে ১০ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ৫ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে জোগান দেওয়ার কথা ছিল।
ওই সময় কমিশন এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, এ প্রকল্পে যে ব্যয় ধরা হয়েছে, তা অস্বাভাবিক ও বেশি। পরে ওই সময়ের পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল প্রকল্পটি একনেক সভায় উপস্থাপন না করে ফেরত পাঠায়।
কিন্তু এক বছর পর প্রকল্পটির ব্যয় আরও বাড়িয়ে পুনর্গঠিত প্রকল্প প্রস্তাব পাঠায় রেলওয়ে। ওই সময় পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন আবদুল মান্নান। সে সময়ে প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপন করা হলে, তা অনুমোদনও দেওয়া হয়। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল।
ওই সময় এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৬ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। চীনা প্রতিষ্ঠান কনস্ট্রাকশ ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানিকে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দেওয়া হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা কমানোর সুপারিশ করলে চীনা ঠিকাদার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না করে ফিরে যায়। ফলে এখনও পর্যন্ত এ প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি নেই।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, একজন বাংলাদেশি ব্যক্তি এই প্রকল্পে চীনা ঠিকাদারের লবিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন, যা প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়াকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।
প্রকল্পের পরিচালক মামুনুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পে চীনের অর্থায়নের কথা থাকলেও এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। চীনের সঙ্গে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি। প্রকল্পের ভবিষ্যৎ বাস্তবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।