কাউন্সিলররা নেই: জন্ম নিবন্ধনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সনদ পেতে ভোগান্তিতে নাগরিকরা
ঢাকার দক্ষিণখানের বাসিন্দা বিলকিস বেগম গত তিন দিন ধরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জোন ৭-এ ওয়ারিশ সনদের খোঁজে যাচ্ছেন। তবে, গতকাল পর্যন্ত তিনি স্থানীয় নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে নিশ্চিত করতে পারেননি, তিনি তার সনদ পাবেন কিনা।
বিলকিস বেগম টিবিএসকে বলেন, "আগে আমরা উত্তরাধিকার সনদ ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে পেয়ে যেতাম। কিন্তু এবার যখন আমি কাউন্সিলরের অফিসে গেলাম, তারা আমাকে উত্তরা জোন অফিসে যেতে বলেন। সেখানে গিয়েও আমি সনদটি পাইনি। যদি আমি এই সপ্তাহের মধ্যে সার্টিফিকেটটি না পাই, তাহলে আমার প্রাপ্য সম্পত্তি দাবি করতে সমস্যা হবে।"
শুধু বিলকিসই নন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ ১২টি সিটি করপোরেশন ও ৩২৩টি পৌরসভায় নাগরিকরা একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। কাউন্সিলরদের বাদ দেওয়ার পর থেকে নাগরিকদের জন্য অপরিহার্য সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
২৬ সেপ্টেম্বর সারাদেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশন ও ৩২৩ পৌরসভার কাউন্সিলরকে অপসারণ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
প্রায় ৬ হাজার কাউন্সিলরকে বাদ দেওয়ার পর, এই অঞ্চলে জনসাধারণের অনেক সেবা বন্ধ হয়ে গেছে।
কাউন্সিলরের অফিস সাধারণত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সনদ সরবরাহ করে, যার মধ্যে রয়েছে: জন্ম, মৃত্যু, নাগরিকত্ব, চরিত্র, ওয়ারিশ, ভূমিহীন, পরিবার, একক, পুনর্বিবাহ না হওয়ার, বার্ষিক আয়, একই নাম, অক্ষমতা, অনাপত্তি, আর্থিক দেউলিয়া, বিবাহ, দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি, নতুন ভোটার, ভোটার স্থানান্তর, বেকারত্ব এবং অস্থায়ী আবাসের সার্টিফিকেট।
এছাড়া, কাউন্সিলরগণ তাদের নিজ নিজ ওয়ার্ডের রাস্তা, ড্রেন উন্নয়ন, সড়ক বাতির ব্যবস্থা, রাস্তা ঝাড়ু ও ড্রেন পরিষ্কার রাখা, মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা, মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা এবং প্রাথমিকভাবে বিবাদ মেটানোর কাজ করে থাকেন।
বর্তমানে এসকল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা জনগণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকায়, অনেকেই বুঝে উঠতে পারছেন না কাজগুলো কীভাবে সম্পাদন করবেন। তারা ধারণা করছেন, জনপ্রতিনিধিদের এ কাজগুলো করতে গিয়ে ভুলত্রুটি ঘটতে পারে।
এর আগে, গত ১৯ আগস্ট সব সিটির মেয়রকে বরখাস্ত করে প্রশাসক নিয়োগ দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ।
কী বলছেন বাদ পড়া কাউন্সিলরগণ?
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের বেশিরভাগ কাউন্সিলর আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে, যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না এবং জনসাধারণের কাছে স্বচ্ছ ব্যক্তিত্বের জন্য পরিচিত– এমন কয়েকজন কাউন্সিলর তাদের ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড ৭-এর কাউন্সিলর মোহাম্মদ সামশুল হুদা টিবিএসকে বলেন, "গত চার বছরে, আমি প্রায় ১১ হাজারের মতো বিভিন্ন সার্টিফিকেট ইস্যু করেছি। এখন আঞ্চলিক কর্মকর্তারা তৃণমূল পর্যায়ের নাগরিকদের সাথে কিভাবে কাজ করবেন? যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত নন এবং ভালো ভাবমূর্তি বজায় রেখেছেন, তাদের কাউন্সিলর হিসেবে রাখা যেতে পারত।"
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি সংরক্ষিত আসনের মহিলা কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "সরকার মহিলা কাউন্সিলরদের রেখে এই কাজগুলো করতে পারত। অন্তত আমাদের আওতাধীন ওয়ার্ডগুলোর জরুরী কাজগুলো চালিয়ে নেওয়া যেত।"
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলী আকবর টিবিএসকে বলেন, "আমার ওয়ার্ডে কোনো সচিবও নিয়োগ দেওয়া হয়নি, যে সচিবের মাধ্যমে কাগজপত্র যাচাই করবে। এখন মানুষকে দক্ষিণখান থেকে উত্তরা গিয়ে সনদ আনতে হবে। আর এক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করারও সুযোগ কম পাবেন কর্মকর্তারা। আমি প্রতিদিন গড়ে ১৫০টির মতো বিভিন্ন সনদ স্বাক্ষর করতাম।"
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, "আমার ওয়ার্ডের জনগণ সকাল থেকে বাসায় এবং অফিসে এসে নাগরিক সেবার জন্য যোগাযোগ করছেন। তারা নাগরিক সনদ, জন্ম নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ, মৃত্যু সনদসহ নানা ধরনের সমস্যায় আছে। জনগণের কোনো সমস্যা সমাধান দিতে পারছি না। জনগণ হতাশায় পড়ে গেছেন।"
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর তানিয়া আক্তার বলেন, "প্রতিদিন অনেক মানুষ সেবা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। যেখানে ৭৬ জন জনপ্রতিনিধিরা দৈনিক দায়িত্ব পালন করতেন, সেখানে ১৯ জন সরকারি কর্মকর্তা নিজেদের কাজের বাইরে এই দায়িত্ব কিভাবে পালন করবেন– যাদের জনসাধারণের সাথে কোন সম্পর্ক নেই?"
খুলনা সিটি করপোরেশনের ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ প্রিন্স বলেন, "আমরা কোনো দলীয় প্রতীকে বা কোনো দল থেকে নির্বাচিত নই। সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জন্য একটি বিরাট বৈষম্য। আমরা জনগণকে সেবা দিতে চাই।"
দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতার অভাব
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জোনাল নির্বাহী কর্মকর্তা (জোন-৫) মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন সরকার দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন আমরা আমাদের জোন অফিস থেকে সকল নাগরিক সেবা প্রদান করার চেষ্টা করছি। আমাদের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা তথ্য ও আবেদন সংগ্রহ করেন এবং যাচাইকরণের পর আমরা স্বাক্ষর করি।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের কর্মকর্তারা নিয়মিত মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের এবং স্যানিটেশন কর্মীদের উপস্থিতি নেন। আমরা অপারেশনগুলো নির্বিঘ্ন রাখতে চেষ্টা করছি। তবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অভাব কিছু সমস্যার সৃষ্টি করছে।"
তবে, অনেকেই এই কাজগুলো কার্যকরভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে কিভাবে কাজ করবে তা বুঝতে সমস্যায় পরছেন। এছাড়া, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে কাজগুলো করে থাকেন, সেখানে ভুল বা অবহেলা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির অন্য একটি জোনাল নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সুজাউদ্দৌলা, যিনি তিনটি জোন (জোন ৬, ৭, এবং ৮) তত্ত্বাবধান করেন, টিবিএসকে বলেন, "আমাদের ওয়ার্ডে প্রধান সমস্যা হলো, এখানে কোন সচিব নেই। যেহেতু আমরা প্রত্যেক নাগরিককে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, তাই পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই করতে কিছু সময় লাগবে।"