এলসি ও মূল্য পরিশোধে বিলম্ব, ইউরিয়া আমদানিতে ১.১৭ লাখ ডলার জরিমানার মুখে বাংলাদেশ
সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার থেকে ইউরিয়া সার আমদানিতে ঋণপত্র (এলসি) ক্লিয়ারেন্স এবং আমদানি মূল্য পরিশোধে দেরি হওয়ার পৃথক দুটি ঘটনায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৩০৯ ডলার জরিমানার সম্মুখীন বাংলাদেশ সরকার।
জিটুজি (সরকারের সাথে সরকারের) চুক্তির আওতায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফার্টিগ্লোব কোম্পানি থেকে সার আমদানির জন্য এলসি কনফার্মেশন পেতে ১৫ দিন দেরি হওয়ার কারণে সার লোড পেতে বুয়াইস বন্দরে অলস পড়ে থাকে জাহাজ। এতে জাহাজ কোম্পানি বাংলাদেশের ওপর ১ লাখ ৭ হাজার ২৪ ডলার ডেমারেজ আরোপ করেছে।
অন্যদিকে, আরেকটি জিটুজি চুক্তির আওতায়, কাতারের মুনতাজাত কোম্পানি থেকে আমদানি করা ইউরিয়া সারের মূল্য পরিশোধ করতে ৮ দিন দেরি করায় বাংলাদেশের কাছে ১০ হাজার ২৮৫ ডলার পেনাল ইন্টারেস্ট দাবি করছে কোম্পানিটি। অর্থাৎ, দুটি ঘটনায় বাংলাদেশকে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩০৯ ডলার জরিমানা গুনতে হবে।
ইউরিয়া সার উৎপাদন, আমদানি, বিতরণ ও মজুদ বিষয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ তথ্য তুলে ধরেন সরকারের যুগ্মসচিব এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপারেশন (বিসিআইসি) এর মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. মনিরুজ্জামান। সভার কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিসিআইসি'র চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জ্বালানী বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ডিসেম্বর থেকে (সারের চাহিদার) পিক সিজন বা বোরো মওসুম শুরু হবে, তাই এসময়ে সম্ভাব্য ইউরিয়া সারের সংকটের আশঙ্কা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের বার্ষিক ইউরিয়া সারের চাহিদা প্রায় ৩০ লাখ তিন, যা মূলত আমদানি করে পূরণ করা হয়।
বিসিআইসির মতে, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ইউরিয়া সারের প্রক্ষেপিত চাহিদা ১৮ লাখ টন, এরমধ্যে বর্তমানে মজুদ আছে প্রায় ৫ লাখ টন।
সভায় বিসিআইসির কর্মকর্তারা সতর্ক করে বলেছেন, এলসি খোলা, কনফার্মেশন বা মূল্য পরিশোধে দেরির কারণে সার আমদানি ব্যাহত হবে। এই সংকট সমাধানের জন্য বন্ধ সার কারখানাগুলোতে দ্রুত গ্যাস সরবরাহ করে উৎপাদন নিশ্চিত করার পাশাপাশি আমদানির উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেন তারা।
তবে সভায় অংশ নেওয়া জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা বিসিআইসিকে জানান, সরকার নিজস্ব উৎপাদনের পাশাপাশি এলএনজি আমদানির মাধ্যমে দেশের গ্যাসের চাহিদা মোকাবেলা করে থাকে। কিন্তু বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদামত মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় নিরবচ্ছিন্নভাবে এলএনজি আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এই মুহূর্তে বন্ধ সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ দেওয়াও সম্ভব না।
আইএমএফ এর ঋণ পাওয়ার শর্ত পূরণের জন্য আপাতত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানান সভায় যোগ দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব উৎস থেকেই মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।
কৃষকদের ইউরিয়া সার জোগানের মূল দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত বিসিআইসি এখন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এছাড়া আসন্ন বোরো মৌসুমে ইউরিয়ার চাহিদা মেটানোর আর কোনো উপায় নেই তাদের।
ডলার সংকটের কারণে গ্যাস ও জ্বালানি তেল আমদানির বিল সময়মত পরিশোধ করতে না পারায় (পেনাল্টি ইন্টারেস্ট) জরিমানা সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া উভয় ধরনের সার আমদানির বিলও সরকার সময়মত পরিশোধ করতে পারছে না। কিন্তু, সার আমদানির বিল পরিশোধে বিলম্বের কারণে এভাবে জরিমানার দেওয়ার তথ্য এবারই প্রথম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সভায় সার আমদানির চ্যালেঞ্জ তুলে ধরতে গিয়ে বিসিআইসির মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মো. মনিরুজ্জামান বলেছেন, কাতারের মুনতাজাত থেকে ১৩ ও ১৪তম লটের মূল্য পরিশোধে দেরি হয়েছে। ১৫তম লটের সারের মূল্য পরিশোধের নির্ধারিত সময় ছিল গত ১৭ জুলাই। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সময়মত ডলার না পাওয়ায় জনতা ব্যাংক ২৫ জুলাই ওই বিল পরিশোধ করে। বিল পরিশোধ করতে ৮ দিন দেরি করায় কাতারের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ১০ হাজার ২৮৫ ডলার ইন্টারেস্ট (সুদ) দাবি করেছে। এটি নিষ্পত্তি করা না হলে কাতারের মুনতাজাত থেকে সার আমদানি বিঘ্নিত হবে।
তিনি আরও বলেন, জিটুজি চুক্তিতে সার আমদানির জন্য এলসি কনফার্মেশনের শর্ত থাকে। দুবাইয়ের ফার্টিগ্লোব কোম্পানি হতে প্রথম দুই লটের এলসি কনফার্মেশন হওয়ায় নিরবচ্ছিন্নভাবে সার আমদানি করা সম্ভব হয়েছে। পরবর্তীতে ফার্টিগ্লোবের মনোনীত আবুধাবীর মাশরেক ব্যাংক এলসি কনফার্মেশন করতে অনীহা প্রকাশ করে। বিসিআইসি কর্তৃপক্ষের অনুরোধে, ফার্টিগ্লোব এলসি কনফার্মেশন ছাড়াই সার সরবরাহ করতে সম্মত হয়। তবে তারা শর্ত জুড়ে দেয় যে, একটি লটের সারের মূল্য পরিশোধের পর পরবর্তী লটের সার জাহাজে লোড দেওয়া হবে। এই শর্তের ভিত্তিতে পরবর্তী ৯টি লটের সার আমদানি করেছে বিসিআইসি।
মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ৯ম লটের সার লোড পেতে জাহাজ বুয়াইস বন্দরে পৌঁছায় গত ২১ জুলাই। ওই সময়ে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ফার্টিগ্লোব কোম্পানির সঙ্গে সাময়িকভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, এবং দেশের পরিস্থিতির কারণে পূর্বের মতো এলসি কনফার্মেশন ছাড়া সার সরবরাহ দিতে বিরত থাকে আমিরাতের কোম্পানিটি।
''জাহাজ বন্দরে পৌঁছার ১৫ দিন পর সোনালী ব্যাংক পিএলসি থেকে অতিরিক্ত গ্যারান্টি দেওয়ার— পর মাশরেক ব্যাংক এলসি কনফার্ম করলে, ফার্টিগ্লোব জাহাজে সার লোড দেয়। এতে জাহাজে ১ লাখ ৭ হাজার ২৪ ডলার ডেমারেজ হয়েছে। ওই ডেমারেজ পরিশোধের জন্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান তাগাদা দিচ্ছে। ইউএই থেকে আমদানি করা এই ৯ম লটের বিলও নির্ধারিত সময়ের ৫ দিন পর পরিশোধ করে বাংলাদেশ''- যোগ করেন তিনি।
মনিরুজ্জামান আরো বলেছেন, সর্বশেষ ফার্টিগ্লোব থেকে ১১তম লটের ৩০,০০০ টন সারের এলসি স্থাপনের জন্য ১ সেপ্টেম্বর সোনালী ব্যাংককে চিঠি দেয় বিসিআইসি। কিন্তু, সোনালী ব্যাংক এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করে। পরে সরকারের উচ্চ পর্যায় হতে যোগাযোগের এক পর্যায়ে ৪ সেপ্টেম্বর সোনালী ব্যাংক এলসি খুলে। কিন্তু, বিদেশি ব্যাংকের থেকে এলসির কনফার্মেশন না হওয়ায় জাহাজ পাঠানো যাচ্ছে না।
সৌদি আরবের সাবিক থেকে ১৫তম লটে আমদানি করা সারের মূল্য বাবদ ৭.৩৫৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতেও ১৫ দিন দেরি করেছে বাংলাদেশ। গত ৫ আগস্ট এই বিল পরিশোধের কথা থাকলেও পরিশোধ করা হয়েছে ২০ আগস্ট।
আসন্ন বোরো মৌসুমের সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ে সার সংকটের আশঙ্কা
সভায় আসন্ন পিক সিজনের জন্য সার মজুত নিয়ে বিসিআইসি-র গভীর উদ্বেগ তুলে ধরনের মনিরুজ্জমান।
গ্যাস না পাওয়ায় বিসিআইসির অধীন প্রায় সব সার কারখানা বন্ধ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। গ্যাস সরবরাহ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সময় সময় সরকারের বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয়নি।
চলতি অর্থবছর কৃষি মন্ত্রণালয় ৩২ লাখ টন ইউরিয়ার চাহিদা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে নিরাপত্তা মজুদের পরিমাণ ৫ লাখ টন।
নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিসিআইসির নিজস্ব কারখানায় মাত্র ৬.৪৬ লাখ টন সার উৎপাদন হয়েছে, যদিও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ লাখ টন। অর্থাৎ, উৎপাদন ঘাটতি হয়েছে ৩.৫৪ লাখ টন। এই উৎপাদন দিয়ে মিনি পিক মওসুমের সারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হয়েছে। জুলাই থেকে মিনি পিক সিজন শুরু হয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলমান থাকে, যা আমন মওসুম নামে পরিচিত।
বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান জানান, এই মুহূর্তে দেশে সারের মজুদ ৪.৩৫ লাখ টন। অক্টোবর ও নভেম্বরে সারের চাহিদা ৪ লাখ টন। এরপর ডিসেম্বর থেকে পিক সিজন বা বোরো মওসুম শুরু হবে। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে সারের চাহিদা প্রায় ১৪ লাখ টন। অর্থাৎ, আগামী মার্চ পর্যন্ত মোট ইউরিয়া সারের চাহিদা ১৮ লাখ টন।