উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ সড়ক বিভাগের
ঠিকাদার নিয়োগে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে (ওপেন টেন্ডার মেথড— ওটিএম) প্রাক-যোগ্যতা যাচাই ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে যোগ্যতার ভিত্তিতে ঠিকাদারদের একাধিক ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হবে বলে জানা গেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্রে।
কর্মকর্তারা জানান, অনিয়ম ও কারচুপি ঠেকিয়ে দরপত্র আহ্বান পদ্ধতিকে আরও নির্ভরযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে নতুন এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তবে এক্ষেত্রে ৩৫ কোটি টাকার বেশি মূল্যের নির্মাণকাজ এবং সাড়ে ৩ কোটি টাকার বেশি মূল্যের রক্ষণাবেক্ষণ কাজের চুক্তির ক্ষেত্রে প্রাক-যোগ্যতা পদ্ধতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের একটি ফরম্যাট তৈরি করে বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক এবং সকল সড়ক জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের মতামত নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের মতামত নিয়ে ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা যাচাই বিষয়ক প্রতিবেদন আগামী সোমবারের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের হাতে আসবে। ওই প্রতিবেদনের পর মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হোসেন গত ২ অক্টোবর টিবিএসকে বলেন, "পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা(পিপিআর) অনুযায়ী প্রাক যোগ্যতা যাচাইয়ের সুযোগ রয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।"
তিনি বলেন, "প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের সুবিধা হচ্ছে, এর মাধ্যমে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ক্যাটাগরি করা যায়। এতে একই প্রতিষ্ঠান বারবার কাজ পাবে না। বেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সুযোগ হবে।"
বর্তমানে উন্মুক্ত পদ্ধতির দরপত্রের সাথে টেন্ডার ডেটাশিট থাকে। সেখানে একটি প্রতিষ্ঠান কী কী যোগ্যতায় কাজটি পাবে, তার উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের একই ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা; এর বাইরে ব্যাংকের দেওয়া ক্রেডিট কমিটমেন্ট সার্টিফিকেট এবং কোম্পানির টার্নওভার গুরুত্বসহকারে দেখা হয়।
জানা গেছে, এসব সমস্যা সমাধানে গত ২৭ আগস্ট রেল ভবনে সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে ইজিপিসহ অন্যান্য পদ্ধতিতে ক্রয় কার্যক্রম সম্পাদনে পিপিএ-২০০৬ এবং পিপিআর-২০০৮ অনুসরণ সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ঠিকাদারদের প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর পূর্ত কাজের প্রাক-যোগ্যতা সংক্রান্ত দলিল ও আদর্শ দরপত্র দলিল তৈরি করবে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তৈরি করা দলিল অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটির (বিপিপিএ) কাছে। বিপিপিএ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সাথে আলোচনা করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবে। পাশাপাশি প্রাক-যোগ্যতা পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য ইজিপি সিস্টেম হালনাগাদ করা হবে।
কার্যপত্রে বলা হয়েছে, সভায় উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ম্যাট্রিক্স পদ্ধতির সংস্কার, প্রাক-যোগ্যতা পদ্ধতির প্রয়োগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সত্যিকার সক্ষমতা (ক্যাপাসিটি) যাচাই এবং ভবিষ্যতে সম্পাদিত পরিচালন বাজেটের দরপত্র প্রক্রিয়ায় মূল্য সমন্বয় (প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট) প্রয়োগের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
তবে আনুষ্ঠানিক মতামত দেওয়ার আগেই বিভিন্ন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীরা ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা এই প্রাক-যোগ্যতা যাচাই পদ্ধতিতে যাওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। তাদের মতে, এই পদ্ধতি নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রাক-যোগ্যতা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, একই ঠিকাদার বারবার যাতে কাজ না পায়, বড় বড় ঠিকাদাররা যাতে কম ব্যয়ের কাজ করতে না আসে, কমিশনের ভিত্তিতে ছোট ঠিকাদারদের সাথে বড় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের জয়েন্ট ভেঞ্চার উদ্যোগ বন্ধ করা এবং ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরের অনিয়ম বন্ধে নতুন এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
ওই আরও কর্মকর্তা জানান, "বাংলাদেশে ছোট কাজের সংখ্যা বেশি। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই ঠিকাদার একাধিক কাজ পাচ্ছেন। অথচ অনেক ঠিকাদার মোটেই কাজ পাচ্ছে না। এতে কাজের মান নিশ্চিত করা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়েছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের এক হিসাবের বরাত দিয়ে তিনি জানান, গত ১৩ বছরে সংস্থাটি প্রায় ৪০ হাজার কাজের দরপত্র আহ্বান করেছে। এরমধ্যে প্রায় ৩৪ হাজার দরপত্রের কাজের মূল্যমান এক কোটি টাকার মধ্যে। আর এসব কাজ নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারই করেছেন। কিছু কিছু কারণে একই ঠিকাদার বারবার কাজ পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ অনুযায়ী উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে দাপ্তরিক প্রাক্কলনের ১০ শতাংশ কম বা বেশি দর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সাধারণত সরকার যে ব্যয় প্রাক্কলন করে, তার চেয়ে কম দর দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়ে ঠিকাদাররা কাজ নেন।
তিনি বলেন, যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দক্ষ জনবল রয়েছে, এই পদ্ধতির কারণে তারা সহজে সরকারের প্রাক্কলিত দর বের করতে পারেন। কারণ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের শিডিউল অফ রেটস সকলের কাছে উন্মুক্ত।
সুতরাং, দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদাররা ওই দরের সাথে যাচিত পরিমাণ গুণ করে সহজেই দাপ্তরিক প্রাক্কলিত ব্যয় সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন। ফলে অধিকাংশ দরপত্রের ক্ষেত্রে ঠিকাদাররা প্রাক্কলিত মূল্যের ১০ শতাংশ কম ব্যয় প্রস্তাব করেন বলে জানান তিনি।
ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা কেন বিপক্ষে মত দিচ্ছেন?
নতুন পদক্ষেপের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মতামত দেওয়ার আগেই গত ৩০ সেপ্টেম্বর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিভিন্ন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীরা ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা এই প্রাক-যোগ্যতা যাচাই পদ্ধতিতে যাওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন।
প্রকৌশলীরা বলেছেন, এই পদ্ধতিতে নতুন ধরনের জটিলতায় পড়তে হতে পারে। পাশাপাশি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হলে রাজনৈতিক সরকার আসলে এই পদ্ধতি হয়ত মানা হবে না। তখন আবার পরিবর্তন আনতে হতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
এজন্য যেকোনো নীতি করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা ও নায্যভাবে কাজ বণ্টনের জন্য এ ক্ষেত্রে লটারি পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব করেছেন প্রকৌশলীরা।
ঠিকাদাররাও এই পদক্ষেপের বিপক্ষে মত দিয়েছেন।
সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি কাজ করা প্রতিষ্ঠান এম/এস ডি এ এন্টারপ্রাইজ এর স্বত্বাধিকারী মুকিতুর রহমান টিবিএসকে বলেন, প্রাক যোগ্যতা যাচাই করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ক্যাটাগরি করা হলে প্রকৌশলীদের একচেটিয়া প্রভাব সৃষ্টি হবে। কারণ একটি ক্যাটাগরিতে একটি জোনে ৫০টি প্রতিষ্ঠান থাকলে তাদের সবাইকে কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রকৌশলী নিজের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন।
তিনি বলেন, "যেসব প্রতিষ্ঠান টেন্ডার ডেটাশিটের সকল শর্ত পূরণ করতে পারবে, তাদের মধ্যে লটারি করে কাজ দেওয়া ভালো। তবে লটারিতে যাতে একই প্রতিষ্ঠান বারবার কাজ না পায়, সেজন্য একটি প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ কতগুলো কাজ পেলে পরবর্তী লটারিতে অংশ নিতে পারবে না, সেটা ঠিক করা যেতে পারে।"
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের উন্নয়ন বরাদ্দ ৩২,০৪২ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকে নতুন ও চলমান প্রকল্পে অর্থায়ন করা হয়। পাশাপাশি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন কাজও করা হবে। এর বাইরে সড়ক সংস্কারে পরিচালন বাজেটের আওতায় ৩,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।