সৌদি কোম্পানির সঙ্গে পতেঙ্গা টার্মিনাল চুক্তির শর্তাবলী পর্যালোচনা করা হবে: নৌপরিবহন উপদেষ্টা
নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, সরকার সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের (আরএসজিটিআই) সঙ্গে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের কনসেশন চুক্তির বিভিন্ন শর্তাবলী পর্যালোচনা করতে প্রস্তুত।
মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) সকালে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিদর্শন শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'তাদের কিছু সমস্যা আছে এবং আমাদের কিছু সমস্যা আছে। সবকিছু ভালো করে পর্যালোচনা করা হবে।'
'তবে আমাদের এমন কিছু করা উচিত নয় যা দেশটির [সৌদি আরব] সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ক্ষতি করে, কারণ আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক প্রবাসী সেখানে কাজ করেন। আমাদেরও পারস্পরিক স্বার্থ রয়েছে। সতর্ক পর্যালোচনার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে,' বলেন তিনি।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'আমরা পূর্ববর্তী দরপত্র এবং দরপত্রের শর্তাবলী পর্যালোচনা করব যাতে কোনো ব্যক্তি বা দলকে — তা দেশি বা বিদেশিই হোক না কেন — অযাচিত সুবিধা দেওয়া না হয়।'
'চট্টগ্রাম বন্দর ও দেশের স্বার্থের ক্ষতি হয় এমন কিছু আমরা করব না,' জানান তিনি।
বন্দরের নিজস্ব তহবিল দিয়ে নির্মিত পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরে সোমবার ৮ অক্টোবর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর প্রকাশিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পর নৌপরিবহন উপদেষ্টা এ সংবাদ সম্মেলন করেন।
যেভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতছাড়া হয় পতেঙ্গা টার্মিনাল
বিদেশি কোম্পানির টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত হোসেন টার্মিনাল কার্যক্রম পরিচালনা সম্পর্কিত সমস্যার কথা স্বীকার করেন।
৮ অক্টোবর বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
২০১৯ সালের ৩১ জুলাই নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সৌদি আরবের আরএসজিটিআই-এর সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। প্রাথমিকভাবে চুক্তিটি জিটুজি-ভিত্তিক (সরকার-থেকে-সরকার) পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলের অধীনে হওয়ার কথা ছিল।
তবে, ২০২২ সালের ৭ জুন যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত আরএসজিটিআই-এর সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
২০২২ সালের জুলাই মাসে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরপরই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) পতেঙ্গা টার্মিনালের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে বছরের নভেম্বরে মায়ানমার থেকে চালবোঝাই জাহাজের বার্থিং এবং পরের বছর জানুয়ারিতে আরেকটি জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে সফল ট্রায়াল অপারেশন অনুষ্ঠিত হয়। এটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের টার্মিনালটি নিজস্ব পরিচালনার সক্ষমতার প্রমাণ দেয়।
বিস্তারিত পড়ুন: যেভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের হাতছাড়া হয় পতেঙ্গা টার্মিনালের পরিচালনা কার্যক্রম
কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার পতেঙ্গা টার্মিনালের জন্য একটি বিদেশি অপারেটর নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে টার্মিনালের কার্যক্রম ২২ বছরের জন্য আরএসজিটিআই-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তখন বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা পতেঙ্গা টার্মিনালটি নিজেই পরিচালনা করতে সক্ষম এবং প্রতিদিন বৈদেশিক মুদ্রায় ১.৬ কোটি টাকা আয় করতে পারবে। টার্মিনালের ৩টি বার্থে কনটেইনার পরিচালনা করে এক বছরে তা ৫৪৬ কোটি টাকায় পরিণত করা সম্ভব।
তৎকালীন বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি চিঠিতে (যেটি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড দেখেছে) এ ধরনের চুক্তিতে বন্দর ও দেশের সম্ভাব্য ক্ষতির কথা উল্লেখ করেন।
প্রসঙ্গত, সিপিএ-এর নিজস্ব তহবিল থেকে ১,২৩০ কোটি টাকায় নির্মিত পতেঙ্গা টার্মিনালের দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতায় আরও পাঁচ লাখ টিইইউ [টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট] যুক্ত করার কথা ছিল।
টার্মিনালটি দুই বছরেরও বেশি সময় আগে নির্মাণ করা হলেও এটির বিদেশি অপারেটর আরএসজিটিআই সরঞ্জামের অভাবে টার্মিনালের সক্ষমতার মাত্র ৮ শতাংশেরও কম ব্যবহার করতে পেরেছে। ফলে বিনিয়োগ থেকে প্রত্যাশিত রিটার্নের চেয়ে অনেক কম রিটার্ন এসেছে এবং ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
চুক্তিতে দেশের স্বার্থে অগ্রাধিকার
সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশের বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগের বৃহত্তর ইস্যু নিয়েও সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন। তিনি জানান, বেশ কয়েকটি বিদেশি সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর এবং সারাদেশের অন্যান্য বন্দরে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, সব চুক্তি দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে করতে হবে।
'বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়ে দেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু আমরা করব না। ন্যায্যতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে সবকিছু করতে হবে,' তিনি বলেন।
প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ দুইই আছে উল্লেখ করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'প্রতিটি দেশই এফডিআইয়ের জন্য আগ্রহী। আমাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে, এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় আমরা সেটাকে অগ্রাধিকার দেব।'
বন্দরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় সরকার
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, পতেঙ্গা টার্মিনালের ইজারা চুক্তি দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সৌদি কোম্পানিকে অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছে।
মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম বন্দরের দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সাখাওয়াত হোসেন এ সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের বিষয়টি নিয়ে লুকোছাপা করেননি।
'এ বন্দরে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে, এবং তা রাতারাতি শেষ হবে না। তবে আমরা এ বিষয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছি,' তিনি মন্তব্য করেন।
বার্থ অপারেটর নিয়োগে দুর্নীতির ইঙ্গিত করে উপদেষ্টা বলেন, 'আত্মীয়দের বার্থ পরিচালনার চুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এগুলোর অনেকগুলো এখন চালু নেই। স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া অপারেটরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
তিনি বন্দরের খবর সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা সাংবাদিকদেরকে যেকোনো অসংগতি শনাক্ত করতে ও রিপোর্ট করতে সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানান। এ সময় তিনি তার সঙ্গে সাংবাদিকেরা সহজে যোগাযোগ করতে পারবেন বলেও আশ্বস্ত করেন।
'আমি এ বন্দরে নতুন। আপনাদের সাহায্য পেলে ভালো লাগবে,' বলেন তিনি।
'বন্দরকে আরও কার্যকর করার লক্ষ্য'
সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রাম বন্দরের স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, 'আমরা এ বন্দরটিকে আরও কার্যকর করার দিকে মনোনিবেশ করছি এবং এর জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন।'
'প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারিং নিশ্চিত করা থেকে শুরু করে দুর্নীতি ও অদক্ষতা মোকাবিলা পর্যন্ত আমরা চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নিচ্ছি,' তিনি বলেন।
বন্দর কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করার চলমান প্রচেষ্টা বিষয়ে তিনি বলেন, 'যদি আমরা সম্পূর্ণরূপে অটোমেশন বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে জাহাজের অপেক্ষার সময় কেটে যাবে। জাহাজ থেকে কনটেইনার লোড এবং আনলোড করার সময়ও কম লাগবে।'
বন্দরে মেয়াদোত্তীর্ণ কনটেইনার ও যানবাহনের জায়গা দখলের দীর্ঘদিনের সমস্যা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
'এখানে ২০ বছর ধরে বসে থাকা কনটেইনার এবং ১২–১৪ বছর ধরে পরিত্যক্ত যানবাহন রয়েছে। এগুলো নিলাম করার দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর), কিন্তু তাদেরকে কী আটকে রেখেছে?'
মেয়াদোত্তীর্ণ এসব জিনিস মূল্যবান জায়গা দখল করতে থাকলে বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো যাবে না উল্লেখ করে এগুলো দ্রুত নিলামের ওপর জোর দেন তিনি।
'প্রয়োজনে আমি এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে প্রক্রিয়াটি দ্রুত করব। এটি সহজতর করার জন্য শুল্ক আইনও সংশোধন করা প্রয়োজন হতে পারে,' বলেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামানসহ বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সম্পাদনা: সুজন সেন গুপ্ত