ভাড়া ও কাস্টমস জটিলতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে জাহাজ চলাচল
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নদী পথে আমদানি–রপ্তানি কন্টেইনারবাহী পণ্য পরিবহনে বুড়িগঙ্গার তীরে কেরানিগঞ্জে নির্মাণ করা হয়েছিল পানগাঁও ইনল্যান্ড কন্টেইনার টার্মিনাল (আইসিটি)। শুরুতে এই রুটে পণ্য পরিবহন স্বাভাবিক থাকলেও ক্রমশ কমছে জাহাজ চলাচল ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং।
২০২৩ সালের শেষ দিকে এই রুটে জাহাজ চালাচল নেমে আসে অনেকটা শূন্যের কোটায়। কাস্টম সংক্রান্ত জটিলতা, ভাড়া বৃদ্ধি, নৌ-রুটে দুর্ঘটনাসহ নানান কারণে এই পথে পণ্য পরিবহনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন আমদানিকারকরা।
চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে পণ্য পরিবহনকারী শিপিং কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ২০ ফুট সাইজের একটি কন্টেইনর পরিবহনের ভাড়া ২০০-২৫০ ডলার। রেল ও সড়কের পথের তুলনায় নদী পথের এই ভাড়া তুলনামূলক বেশি বলে অভিমত আমদানিকারকদের।
এছাড়া, গত বছরের ৬ জুলাই পানগাঁও আইসিটিতে যাওয়ার পথে পানগাঁও এক্সপ্রেস জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনার পর, এই পথে পণ্য পরিবহনে একেবারে ধস নেমে আসে। চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাধীন এই জাহাজটি পরিচালনা করতো শিপিং কোম্পানি সি গ্লোরি।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর-পানগাঁও রুটে জাহাজ চলাচল করেছে ১৪৭টি। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে জাহাজ চলেছে মাত্র ১৬টি।
২০২৩ সালের জানুযারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রতিমাসে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫টি পর্যন্ত জাহাজ চললেও সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি মাসে এই সংখ্যা নেমে আসে ১ থেকে সর্বোচ্চ ৪টিতে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই রুটে একটি জাহাজও চলাচল করেনি।
রুটটিতে ৮টি জাহাজ পরিচালনা করে শিপিং কোম্পানি সি গ্লোরি।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পারিচালক জহিরউদ্দিন জুয়েল আরও বলেন, "সি গ্লোরি জাহাজ ডুবে যাওয়ার কারণে পণ্য পরিবহন কমে গেছে— ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগ সঠিক নয়; বরং পানগাঁও কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের হয়রানিই এর প্রধান কারণ।"
তিনি বলেন, "নৌ-রুটে যে কন্টেইনার পরিবহন হয়, সেগুলো পণ্য এবং কন্টেইনার-সহ ওজন ২৫ থেকে ৩০ টন। ভারী এসব কন্টেইনার সড়ক পথে পরিবহন করতে গেলে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এসব কন্টেইনার এখন রেলপথে পরিবহন করছেন আমদানিকারকরা।"
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁও রুটে প্রায় অর্ধেক পণ্য পরিবহন হয় মায়ের্কস লাইনের। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দুই বছর আগেও এই রুটে প্রতি মাসে অন্তত ৪০০ টিইইউ (টুয়েন্টিফুট ইক্যুইভ্যালেন্ট ইউনিট) কন্টেইনার পরিবহন হতো মায়ের্কসের। এখন এই পরিমাণ নেমে এসেছে সর্বোচ্চ ৩০ টিইইউতে।
এর কারণ হিসেবে মায়ের্কস লাইন চট্টগ্রাম অফিসের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "এই রুটে পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ার প্রধান দুটি কারণ হলো— পানগাঁও কাস্টমসের হয়রানি ও পণ্য খালাসে বিলম্ব হওয়া এবং গতবছর সি গ্লোরি জাহাজ ডুবে যাওয়ার দুর্ঘটনা। মূলত এ দুটি কারণে আমদানিকারকরা এই পথে পণ্য পরিবহনে আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।"
তিনি বলেন, "যদিও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তপক্ষ কাস্টমস এবং ভাড়ার বিষয়টি দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু এই রুটে পণ্য ডুবে গেলে এর দায় কারা নেবে, সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে আমদানিকাকরদের।"
এদিকে, পানগাঁও টার্মিনালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমকে গতিশীল করতে গত ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরে একটি স্টেকহোল্ডার মিটিং করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ওই সভায় কাস্টম, ট্যারিফ-সহ সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস. এম. মনিরুজ্জামান।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, "চট্টগ্রাম-পানগাঁও-চট্টগ্রাম রুটে জাহাজের বিদ্যমান ভাড়া হ্রাস কল্পে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইতোপূর্বে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে নদীপথে কন্টইেনার পরবিহনের ভাড়া প্রতিযোগিতামূলক হয়ে র্বতমানের চেয়ে ব্যাপক হ্রাস পাবে।"
তিনি জানান, ২০২২ সালে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই রুটে পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি করে। প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করার অনুরোধ জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশেনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ টিবিএসকে বলেন, শিপিং এজেন্টগুলো রেফারেন্স লাইসেন্স দিয়ে কমলাপুর আইসিডিতে কাজ করতে পারলেও পানগাঁও আইসিটিতে কাজ করতে পারছিল না। পানগাঁও কাস্টম এ বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছিল।
"বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বিষয়টির সমাধান করবেন বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। এই রুটে পণ্য পরিবহন ভাড়া উন্মুক্ত থাকলে আমদানিকারক জাহাজ মালিক দরকষাকষির মাধ্যমে ঠিক করবেন," যোগ করেন তিনি।
পানগাঁও কাস্টম হাউসের কমিশনার শওকত আলী সাদি টিবিএসকে বলেন, "আমি এই কাস্টম হাউসে কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি দেড় মাস হয়েছে। পণ্য খালাসে বিলম্ব-সহ যেসব হয়রানির অভিযোগ ছিল, সেগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। আইন ও বিধিবিধান মেনে ব্যবসায়ীরা যাতে দ্রুত সেবা পান, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।"
তিনি বলেন, এই রুটে পণ্য পরিবহন বাড়াতে হলে, ভাড়া কমাতে হবে। কারণ রেলপথে পণ্য পরিবহনের তুলনায় নদী পথে পরিবহন ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ।
"এছাড়া, জাহাজ চলাচলে কোনো নির্ধারিত শিডিউলও নেই। ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত হতে পারেন না পণ্য নিয়ে কখন জাহাজ ছেড়ে যাবে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এই দুই সমস্যার সমাধান হলে চট্টগ্রাম-পানগাঁও রুটে পণ্য পরিবহন বাড়বে," যোগ করেন তিনি।