আতঙ্কের সাম্রাজ্য: ‘ডিবি হারুন’ যেভাবে চাঁদাবাজিকে পুলিশি অভিযানে রূপ দিতেন
জায়গাটা ছিল একটা কল সেন্টারের মতো—তবে এখানে প্রথাগত কল সেন্টারের উল্টো কাজ হতো। এখানে বিপদগ্রস্ত নাগরিকরা সাহায্য চেয়ে ফোন করতেন না, বরং পুলিশ কল করে ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা চাইত।
২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার হিসেবে হারুন-অর-রশীদের রাজত্বের কথা এভাবেই স্মরণ করেন ভুক্তভোগীরা। এ সময়ে অসদাচরণের জন্য তাকে দুবার প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
তখন—'ডিবি হারুন' নামে কুখ্যাত হয়ে ওঠার আগেই—চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের আতঙ্কে রাখার জন্য কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
হারুনের চাঁদা দাবির শিকার হয়েছিলেন অ্যাম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শওকত আজিজ রাসেল। তিনি বলেন, 'হারুন সহকর্মী অফিসারদের সাহায্যে কার্যত একটা চাঁদাবাজির কল সেন্টার চালাতেন।'
ফোনকলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের মতো জাতীয় দিবসগুলো উদযাপনের নামে কারখানামালিকদের কাছে টাকা দাবি করতেন হারুন। অধস্তন কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে এসব দাবি আদায় করতেন।
রাসেল বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উদযাপনের জন্য গাজীপুরের প্রত্যেক শিল্পপতির কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে দাবি করেছিলেন হারুন।
'গাজীপুরে প্রায় ৩ হাজার কারখানা আছে। ১ হাজার মালিকও যদি চাঁদা দেয়, তাহলেও প্রায় ৫০ কোটি টাকা হয়। টাকা দিতে রাজি না হলে কারখানায় আক্রমণ হতো,' বলেন তিনি।
এমনকি জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখনও হারুন দমন-পীড়ন চালিয়ে যান। ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে তাদেরকে সরকারবিরোধী তকমা দেওয়ার হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি আন্দোলনে অর্থায়নের অভিযোগ আনতেন হারুন।
এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো ১৮ জুলাই ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও কেএম রেজাউল হাসানাতের (ডেভিড) গ্রেপ্তার।
ন্যায়পরায়ণতার জন্য সুপরিচিত ডেভিডকে সেতু ভবনে অগ্নিসংযোগের কাজে অর্থায়নের অভিযোগে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। ডেভিডকে এভাবে গ্রেপ্তার করায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল ব্যবসায়ী মহলে।
হুমকি ও মিথ্যা মামলা
২০১৬ সালের মে মাসে হারুন অ্যাম্বার গ্রুপের রাসেলের কাছে ৫ কোটি টাকা দাবি করেন। রাসেল টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে রাতের বেলায় হারুন তার কারখানায় অবৈধ অভিযান চালিয়ে ৪৫ জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন।
রাসেলকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছিলেন হারুন। কিন্তু রাসেলকে না পেয়ে ২০১৯ সালে তার স্ত্রী ও ছেলেকে মাদক মামলায় আটক করা হয়। তবে সিসিটিভি ফুটেজে তাদের নির্দোষিতা প্রমাণ হয়। পরে হারুনকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে প্রত্যাহার করা হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনরত রাসেল সরকারের প্রতি ব্যবসার প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা এবং এ ধরনের নির্যাতন বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের কাছেও চাঁদা দাবি করেন হারুন। প্রতিষ্ঠানটির একটি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর তিনি মালিকের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা অবহেলার অভিযোগ এনে তার কাছে ৩ কোটি টাকা দাবি করেন।
ট্যাম্পাকো ফয়েলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিউস সামি আলমগীর বলেন, 'আগুন লেগেছিল দুর্ঘটনাবশত, যা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।'
তবে ট্যাম্পাকো ফয়েলস টাকা দিতে রাজি না হলে হারুন প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেন বলে জানান কোম্পানিটির কর্মকর্তারা। ভুয়া খুনের মামলা সাজান তিনি।
এসব কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে কারখানার শ্রমিকদের উসকানি দেন হারুন। এসব করে শেষপর্যন্ত তিনি বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করেন বলে জানান কোম্পানিটির কর্মকর্তারা।
হারুনের আতঙ্কের হোটেল
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী জানান, কীভাবে হারুন গুলশানের একটি হোটেলে ধনী ব্যক্তিদের ডাকতেন। সেখানে তার আর্থিক দাবি মেটানো না হলে ব্যবসায় ঝামেলা করার বা মিথ্যা মামলা দেওয়ার হুমকি দিতেন।
অন্তত দশজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও তাদের পরিবারকে এমন বৈঠকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। তাদের কাছে হারুন কোটি কোটি টাকা দাবি করেছিলেন।
একবার বিজিএমইএর একজন সাবেক সভাপতি ওই হোটেলে নয় ঘণ্টা আটক ছিলেন। অতীতে বিরোধীদলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় তাকে ১০ কোটি টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। পরে অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
মাসিক চাঁদাবাজি
ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, হারুন ব্যবসার আকার অনুযায়ী চাঁদার পরিমাণ ঠিক করে দিতেন। ছোট কারখানার মাসিক চাঁদা ৫ লাখ টাকা, মাঝারি আকারের কারখানার চাঁদা ৮ লাখ টাকা এবং বড় কারখানার চাঁদা জন্য ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা। কখনও কখনও দাবির পরিমাণ ১ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছাত।
যেসব কোম্পানি এই ঘুষ দিতে রাজি হতো না, তাদের কপালে জুটত হয়রানি, হামলা-মামলা ও হারুনের সহযোগীদের হাতে সামাজিক হেনস্তা।
এছাড়াও হারুন বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠক বিঘ্নিত করতেন। তাদের বিরুদ্ধে 'বিএনপি-জামায়াতের গোপন বৈঠক' করার মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে গ্রেপ্তারের হুমকি দিতেন।
হারুন সর্বশেষ খবরের শিরোনামে আসেন যখন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে আটক করে।
১ আগস্ট তাকে গোয়েন্দা শাখা থেকে অপসারণ করে ডিএমপির অপরাধ ও অপারেশনস বিভাগে বদলি করা হয়।
তবে এই নতুন পদে তিনি বেশিদিন চাকরি করতে পারেননি। ২ আগস্টের মধ্যেই তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। এখনও তিনি আত্মগোপনেই আছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যার অভিযোগ রয়েছে।