ট্রেনের ধাক্কায় আহত হস্তীশাবকের মৃত্যু, রেল কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করল বন বিভাগ
রোববার রাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনের চুনতি এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় গুরুতর আহত হওয়া হাতির বাচ্চাটি মারা গিয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা এ মৃত্যুর জন্য রেল কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করছেন।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বিকেল ৫টার দিকে হস্তীশাবকটি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে জানিয়েছেন ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের ইনচার্জ মাজহারুল ইসলাম। এর আগে উন্নত চিকিৎসার জন্য এ দিন সকালে এটিকে সাফারি পার্কে নেওয়া হয়েছিল।
মাজহারুল বলেন, বাচ্চাটির ওজন ছিল প্রায় ৫ মেট্রিক টন। ময়নাতদন্তের পর তার এটির লাশ পার্কটিতে কবর দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, 'এ বিষয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হবে।'
'হাতিটিকে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাফারি পার্কে নিয়ে আসা হয়। দুর্ঘটনা ঘটার পর রোববার সকাল থেকে এটিকে রেললাইনের পাশে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের একটি রিলিফ ট্রেন হাতি পরিবহনে আমাদের সহায়তা করেছে।'
মাজহারুল জানান, 'সিভিএএসইউ [চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়] অধ্যাপক ডা. বিবেক চন্দ্র সূত্রধরের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞ পশুচিকিৎসকেরা বাচ্চাটির চিকিৎসায় তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।'
অধ্যাপক ডা. বিবেক চন্দ্র সূত্রধর জানান, হাতিটির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন ছিল। 'আমরা তার আঘাতের সারানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি,' বলেন তিনি।
'বাচ্চাটির বাম দিকের একটি পা মারাত্মকভাবে ভেঙে গিয়েছিল। মেরুদণ্ডের একটি চাকতিও স্থানচ্যুত হয়। এছাড়া মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাত পেয়েছিল এটি। দাঁড়াতেও পারছিল না, নড়াচড়া করাও অসম্ভব ছিল। এছাড়া এটি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে,' বলেন এ অধ্যাপক।
রেলের অবহেলা দায়ী: বন বিভাগ
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ করার সময় হাতিদের নিরাপদে পারাপার নিশ্চিত করতে একটি ওভারপাস এবং ৩টি আন্ডারপাস তৈরি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এছাড়াও, হাতি যাতে রেললাইনে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য দুপাশে দেয়ালও নির্মাণ করা হয়েছিল।
চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা নূর জাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মানুষের চলাচলের জন্য তৈরি পকেট গেটগুলো অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয়েছে। এ অবহেলার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেন তিনি।
'রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের স্টিলের গ্রিল বসানোর কথা ছিল, কিন্তু তারা সেগুলো খোলা ও অরক্ষিত রেখে দিয়েছে। হাতির বাচ্চাটি এ গেটের মধ্য দিয়ে রেললাইনে প্রবেশ করে এবং ট্রেনের ধাক্কায় আহত হয়,' বলেন তিনি।
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, 'এ ঘটনায় লোহাগাড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।'
এদিকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. সুবক্তগীন টিবিএসকে বলেন, বন বিভাগের অনুরোধ অনুযায়ী এক মিটার পকেট গেট রাখা হয়েছে। 'প্রকল্পটি এখনো শেষ হয়নি এবং আমরা পকেট গেট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
তিনি বলেন, 'প্রকল্পের সহযোগীরা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) কর্মকর্তারা হাতিদের ট্রেনের মুখোমুখি হওয়া কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে কাজ করছেন। আমরা রেললাইনের পাশে এআই সেন্সরযুক্ত ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা করছি। কোনো হাতি রেললাইন পার হলে কাছাকাছি স্টেশন ও ট্রেনের অপারেটরকে সংকেত পাঠাবে এগুলো।'
তিনি আরও বলেন, 'আর কোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে আমরা ২৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গতিসীমা নির্ধারণের পরিকল্পনা করছি।'
এর আগে রোববার (১৩ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনটি চুনতি এলাকায় হাতি পারাপারের জন্য তৈরি ওভারপাসের কাছে হাতির বাচ্চাটিকে ধাক্কা দেয়।
উল্লেখ্য, বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে ২৭ কিলোমিটার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ বরাবর হাতির ১৬টি করিডোর চিহ্নিত করা হয়েছিল। এসব বন বিপন্ন এশিয়ান হাতির আবাসস্থল। হাতির খাদ্য ও জলের সন্ধানে একাধিক আবাসস্থলের মধ্যে চলাচলের জন্য এ করিডোরগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাতির নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চুনতিতে একটি ওভারপাস তৈরি করেছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় রেলপথের ওপর প্রথম তৈরি করা হাতির ওভারপাস।
তবে বন্যপ্রাণী অধিকারকর্মী ও সমালোচকদের যুক্তি, রেলওয়ের নির্মিত এসব ওভারপাস ও আন্ডারপাস পর্যাপ্ত নাও হতে পারে, যা এসব প্রাণীর টিকে থাকার জন্য হুমকি হতে পারে।
মোট ১০২ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে প্রায় ২৭ কিলোমিটার চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ফাসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচাপিয়া জাতীয় উদ্যানের মধ্য দিয়ে গেছে। এসব বনাঞ্চল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলে এশিয়ান হাতির গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল।
২০১৬ সালে সরকার ২৭৬ একর বনাঞ্চল ব্যবহার করে রেললাইন নির্মাণের জন্য অনুমতি দেয়। এতে সাত লাখ ২০ হাজার ৪৪৩টি গাছ কেটে ফেলতে হয় এবং বদলাতে হয় ২৬টি পাহাড়ি পরিবেশও।
রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয় ২০১৮ সালের মার্চে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এ পথে ট্রেন চলাচল করতে শুরু করে।