দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন আয়ের মানুষ
রিকশাচালক মো. হারুন ১৫ হাজার টাকা জোগাড় করার জন্য মরিয়া হয়ে কোনো অলৌকিক ঘটনার অপেক্ষায় আছেন।
ছয় মাস আগে রিকশা দুর্ঘটনায় গুরুতর ফ্র্যাকচার হওয়ার পর তার বাম পায়ে ঢোকানো ইন্ট্রামেডুলারি রড অপসারণের জন্য এই পরিমাণ টাকার প্রয়োজন।
খাবারের দাম বেড়ে যাওয়া এবং কাজ করতে না পেরে কল্যাণপুর বস্তিতে নিজ বাড়িতে শয্যাশায়ী হারুন সামনে কী করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন।
হারুনের স্ত্রী গোলানুর বেগম এক মুঠো পটল হাতে নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ভাতের সাথে এছাড়া তাদের খাওয়ার আর কিছু নেই।
গৃহকর্মীর কাজ করা গোলানুর বলেন, তিনি এখন মাত্র ১ হাজার টাকা উপার্জন করেন, যা তাদের পরিবারের খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
গোলানুর বলেন, "আমাদের তিন মাসের ভাড়া বাকি আছে, সাড়ে ৭ হাজার টাকা দেনা আছে। আমরা প্রতিবেশীদের দয়ায় বেঁচে আছি। কিন্তু এইভাবে আর কতদিন চলতে পারব, জানি না।"
দুর্ভাগ্যজনকভাবে গোলানুরের কাছে টিসিবি কার্ড নেই, যার মাধ্যমে তিনি সরকারি সুবিধায় খাদ্যসামগ্রী কিনতে পারতেন। টিসিবি কার্ডধারীরা ৩০ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি চাল, ১০০ টাকা লিটারে ২ লিটার ভোজ্য তেল এবং ৬০ টাকা কেজি দরে ২ কেজি ডাল কিনতে পারেন।
গোলানুর দাবি করেন, "আমরা কল্যানপুর বস্তির বিএনপি গলি নামে পরিচিত অংশে থাকি কারণ এটি বিএনপি সমর্থকদের এলাকা হিসেবে বিবেচিত। এ কারণে আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের কোনো সুবিধা দেয়নি। আমি চার বছর ধরে এখানে আছি। কিন্তু কোনো সহায়তা পাইনি।"
রাজমিস্ত্রী মো. জাকারিয়া একই বস্তি এলাকায় বসবাস করেন এবং সৌভাগ্যবশত তিনি একটি চাকরি করেন, যা থেকে প্রতিদিন ৮০০ টাকা উপার্জন করেন। তবে, গত তিন মাসে কাজের অভাব দেখা দেওয়ায় বর্তমানে সপ্তাহে গড়ে মাত্র চার দিন কাজ হচ্ছে।
জাকারিয়া বলেন, "আমি ভাড়ার জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং রান্নার গ্যাসের জন্য ১ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয় করি। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ার কারণে আমরা প্রায় এক মাস ধরে মুরগির মাংস খাইনি এবং ১২ দিন আগে শেষ ডিম কিনেছি।"
জাকারিয়া আরও বলেন, "ভাত, ডিম, মাছ এবং সবজিসহ সবকিছুরই দাম বেড়ে গেছে।" বর্তমানে ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে ২০০ টাকা দরে এবং এক হালি ডিমে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, "চালের দাম ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকা হওয়ায় আমি বাধ্য হয়ে নিম্নমানের চাল ৬০ টাকায় কিনছি। এমনকি, নিম্ন সবজির দামও কেজিতে ৮০ টাকার কাছাকাছি আর তাজা সবজির দাম ১০০ টাকা কেজি।"
রাজধানীতে প্রায় ৩০টি নিম্ন আয়ের পরিবারের সঙ্গে সোমবার (১৪ অক্টোবর) কথা হয় টিবিএসের। তারা জানান, বাড়তি দামের কারণে তাদের জন্য জরুরী পণ্য কেনা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ বলছেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় টাকার অভাবে সন্তানকে স্কুলে পড়তে দিতে পারছেন না।
এই সংগ্রাম শুধু বস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রাইডশেয়ার মোটরসাইকেল চালক আবু তালেবের মাসিক উপার্জন গত ৫ থেকে ৬ মাসে ৩০ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।
তিনি খিলগাঁওয়ের একটি এক রুমের বাসায় সাবলেট থাকেন, যেখানে তিনি ৭ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া দেন। তার ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তাকে কলেজে ভর্তি করানোর সামর্থ্য তালেবের নেই। আর একই কারণে দশম শ্রেণিতে পড়া তার মেয়ের ভবিষ্যতও অন্ধকার। এছাড়াও, তিনি প্রতিমাসে ৩ হাজার টাকা তার বয়স্ক মায়ের জন্য সিরাজগঞ্জে পাঠান।
তালেব দুঃখ করে বলেন, "সবজির দাম দ্বিগুণ হয়ে ১০০ টাকা কেজি হয়েছে এবং এই বছর আমার সন্তানেরা ইলিশ মাছসহ এবং অন্যান্য যেসব খাবার খেতে চেয়েছিল, আমি সেগুলো কিনতে পারিনি।"
ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) থেকে প্রকাশিত এক নিয়মিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন প্রায় ৩৬ শতাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ। সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় ৩৭ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে।
৯ অক্টোবর প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। এতে বলা হয়, বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা বৃদ্ধির কারণে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মূল্যবৃদ্ধির কারণে ৩০ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্য গ্রহণ করছে এবং ৪২ শতাংশ পরিবার খাদ্য কিনতে ঋণ করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়াও, ২৬ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য খরচ কমিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ পরিবারের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে।
প্রয়োজনীয় পণ্যের খরচ বাড়ছে
ব্যবসায়ীরা মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ধারাবাহিক বৃষ্টির ফলে ফসলের ক্ষতি এবং এর ফলে সবজি উৎপাদন কমে আসার কথা বলছেন। অনেক কৃষক শীতকালীন ফসল বপন করতে পারেননি এবং যারা করেছেন তাদেরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা আরও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
সরকার নির্ধারিত মূল্যসীমা থাকা সত্ত্বেও, ডিম এবং মুরগি এখনও নিয়ন্ত্রিত মূল্যের ওপরে বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে একজন ভোক্তা সুভাষ সাহা মন্তব্য করেন, "আমি আগে এক কেজি বেগুন কিনতাম। কিন্তু এখন আমি তার অর্ধেকও কিনতে পারি না। আমি সপ্তাহে দুটি ডিম খেতাম, এখন একটি খেতে হচ্ছে।"
অভিযোগ করে তিনি বলেন, "সরকার দাবি করছে দাম কমাবে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। আমি শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বাজার পর্যবেক্ষণের কথা শুনেছি। কিন্তু আমি তাদের এখানে দেখতে পাচ্ছি না। আমার বেতন বাড়ছে না, কিন্তু খরচ বাড়ছে।"
১৪ অক্টোবর বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজার পর্যবেক্ষণের জন্য কারওয়ান বাজারে যান। তিনি বাড়তে থাকা দাম নিয়ে জনগণের উদ্বেগ স্বীকার করেন এবং বলেন, "আমরা দাম বাড়ানোর বিষয়ে সন্তুষ্ট নই এবং ভোক্তাদের সমস্যা সমাধানে কাজ করছি।"
তিনি আরও বলেন, অতিরিক্ত মুনাফা নিয়ে কোনো ধরনের অব্যবস্থাপনা কঠোরভাবে সমাধান করা হবে।
এদিকে, সরকার গতকাল ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে কম দামে বিক্রি করার একটি কর্মসূচি চালু করেছে।
এই উদ্যোগের আওতায় গ্রাহকরা ৩০ টাকায় ১ কেজি আলু, ১৩০ টাকায় একটি ডজন ডিম, ৭০ টাকায় ১ কেজি পেঁয়াজ এবং ২০ টাকায় পেঁপে কিনতে পারবেন।