আদালতের নির্দেশে কবর থেকে তোলা হয়েছে বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ
উচ্চ আদালতের নির্দেশে ঢাকার সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের একটি কবরস্থান থেকে বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ উত্তোলন করা হয়েছে।
দুপুর দুইটা নাগাদ দেহাবশেষ বিরুলিয়া ইউনিয়নের কামালপুর এলাকায় জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদরাসার জামিয়া খাতামুন কবরস্থান থেকে উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে ডিএনএ টেস্ট শেষে হারিছ চৌধুরীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী দেহাবশেষ সিলেটে যথাযথ মর্যাদায় দাফন করা হবে বলে জানা গেছে।
আজ বুধবার (১৬ অক্টোবর) সকাল সাড়ে আটটার দিকে উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নের কমলাপুর এলাকার কবরস্থানটি থেকে দেহাবশেষ উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করা হয়।
এ কার্যক্রমে উপস্থিত রয়েছেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আহম্মেদ মুঈদ, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এস এম রাসেল ইসলাম নুরসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেহাবশেষ উত্তোলন কার্যক্রম। এতে ছয় জন শ্রমিক কাজ করছেন। উপস্থিত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
এর আগে, হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিম চৌধুরীর করা এক রিটের শুনানি শেষে গত ৫ সেপ্টেম্বর হারিছ চৌধুরীর লাশ কবর থেকে তুলে ডিএনএ টেস্টের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এস এম রাসেল ইসলাম নুরকে লাশ উত্তোলনের সময় উপস্থিত থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
মাহমুদুর রহমান হিসেবে দাফন
তিন বছর আগে হারিছ চৌধুরীকে এ কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেই সময় তাকে মাহমুদুর রহমান হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল পরিবার। কবরটি তাৎক্ষণিক কিনে নেয় তার স্বজনরা। তার জানাজায় অংশ নিয়েছিল স্থানীয় অনেকেই।
হারিছ চৌধুরীর জানাজা পড়ানো মাওলানা আশিকুর রহমান কাশেমি বলেন, "২০২১ সালের ওই দিন বাদ আসর আমি ওই নামাজের জানাজায় ইমামতি করি। এতে অনেকেই উপস্থিত অংশ নেয়। দাফনের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। তখন করোনার পরিবেশ ছিল। জানাজার নামাজেও মানুষ সাহস পেত না। তার শ্যালক যোগাযোগ করে মরদেহ নিয়ে আসে। আমরা অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান হিসেবে তার মরদেহ দাফন করি। এখন পর্যন্ত আমরা তাকে অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান হিসেবেই জানি।"
বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সামাদ মোল্লা বলেন, "এখানে অনেকেই কবরের জন্য জমি কেনে। এটা অন্যের নামে বরাদ্দ ছিল। মাহমুদুর রহমানের আত্মীয়রা বললো, কবরের জায়গা লাগবে। তখন আরেকজনের বরাদ্দ করা কবরের জমি বিক্রি করা হয়। তখন এলাকার বা মাদরাসার কেউ জানতো না এটিই হারিছ চৌধুরীর মরদেহ। আমরা জানতাম তার নাম মাহমুদুর রহমান।"
দাফন হবে শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী
হারিছ চৌধুরীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার জন্মভূমি সিলেটে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছে পরিবারের সদস্যরা।
হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিম চৌধুরী বলেন, "তারা মানতে রাজি নন, মাহমুদু্র রহমান আমার বাবা। আমার দাদা বাড়ি নিয়ে তাকে দাফন করতে দেয়নি। তারা আমার বাবার মৃত্যু সনদ দেয়নি। মৃত্যুটাতো মীমাংসা করতে হবে। বাবার মৃত্যু নিয়ে তো ধূম্রজাল থাকতে পারে না। অনেকেই বলছে, হারিছ চৌধুরী মারা যাননি। পালিয়ে আছেন, গা ঢাকা দিয়ে আছেন। যাচ্ছে তাই বলা হচ্ছে। একটা সৎ ভালো মানুষকে ক্রিমিনাল সাজানো হয়েছে। সত্যি লুকিয়ে রাখা যায় না। এখন এটা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। তার সম্মান সে ফিরে পাচ্ছে। আব্বুর যে শেষ ইচ্ছা ছিল, সে অনুযায়ী তার দাফন হবে। আদালত যেভাবে বলবে সেভাবেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।"
সামিরার ফুপা মো. নাজমুল আরিফ খান বলেন, ডিএনএ টেস্ট হয়ে গেলে আশা করছি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হবে। উনার ইচ্ছা অনুযায়ী সিলেটে তাকে কবরস্থ করা হবে।
দেহাবশেষ উত্তোলনের বিষয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) আহমেদ মুঈদ বলেন, "যে দেহাবশেষ উত্তোলন করা হচ্ছে, আমরা জানতে পেরেছি এটি হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ। তিনি যখন মারা যান, ওই সময় বিশ্বে করোনা চলছিল। তার পরিবার তাকে নিরাপদ ও ভালো জায়গায় কবরস্থ করতে এখানে নিয়ে আসে। তার মেয়ে একটা রিট করেন গত ২৪ সেপ্টেম্বর। ওই পিটিশনের প্রেক্ষিতে পাঁচটি সংস্থা এখানে আসে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন, রেজিস্টার্ড জেনারেলের কার্যালয়ের একজন প্রতিনিধি, জেলা পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাভার থানা পুলিশ উপস্থিত রয়েছে। সবার উপস্থিতিতে কবর খনন করা হচ্ছে। এরপর দেহাবশেষ চিহ্নিতে যা যা সংগ্রহ করা দরকার, সেগুলো নেওয়া হবে। এরপর পরীক্ষা নিরিক্ষার পর জানা যাবে এটিই হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ কিনা। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। পরিবার তাকে রাষ্ট্রীয় যথাযথ সম্মান দেওয়ার দাবি করেছে। এ বিষয়ে সরকার ব্যবস্থা নেবে। আর পরিবারের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে দাফন করা হবে।"
আদালতের নির্দেশে দেহাবশেষ উত্তোলন
গত ৮ সেপ্টেম্বর আদালতের দেওয়া এক নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নং-১০৭৮৭/২৪ এ হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ উত্তোলন করে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য আদালত আদেশ দেন। তার মেয়ে সামিরা তানজিম সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করেন।
সেখানে বলা হয়, তার বাবা হারিছ চৌধুরীকে জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন মাদরাসার জামিয়া খাতামুন কবরস্থানে মাহামুদুর রহমান নামে দাফন করা হয়। হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ কবর হতে উত্তোলন করে তার পরিচয় প্রমাণের জন্য ডিএনএ পরীক্ষা করানো, পরিচয়ের ইতিবাচক ফলাফল, মৃত্যু সনদ পাওয়া, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ থেকে তার নাম মুছে ফেলা এবং তাকে নিজ জেলায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দাফন করার জন্য আবেদন করেন।
পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশনের আদেশে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৭৬(২) ধারার বিধান অনুযায়ী হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ উত্তোলনের সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল দায়িত্ব পালনের জন্য এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এসএম রাসেল ইসলাম নুরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, হারিছ চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মারা গেছেন। প্রবাসী মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা চৌধুরী তখন জানান, তার বাবা ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা গেছেন।
হারিছ চৌধুরী বিএনপির সবশেষ শাসনামলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন।