৩.১৩ কোটি টাকার সেতুতে ৬ মাস না পেরোতেই ধস
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার চিনাটোলা বাজারে হরিহর নদের ওপর নির্মিত সেতুটি স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে উন্নতির আশা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পর ছয় মাস না পেরোতেই সেতুটির বিভিন্ন স্থান ধসে পড়েছে। ফলে মানুষের আশা পরিণত হয়েছে ক্ষোভ ও অবিশ্বাসে।
সেতুতে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও দুর্নীতির কারণে এই অবস্থা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মাত্র ছয় মাসে পেরোতেই সেতুর এই বেহাল দশায় স্থানীয়দের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ সেতুর পাটাতন সংস্কারের কাজ শুরু করলে স্থানীয়রা বাধা দিয়েছেন। নতুন করে সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর বলছে, হরিহর নদের ওপর ৪২ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩.১৩ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের ১২ নভেম্বর সেতুটি উদ্বোধনের কথা থাকলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে তা হয়নি। পরে চলতি বছরের মার্চে জনসাধারণের চলাচলের জন্য সেতু উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
গত আগস্টের প্রথম দিকে সেতুর পাটাতনের পলেস্তারা ধসে পড়তে শুরু করে। ধীরে ধীরে বড় একটি অংশ ধসে রড বেরিয়ে পড়ে।
গত দুই মাস ধরে সেতু পারাপারে ভোগান্তিতে পড়েছে পথচারীরা। এই সেতুর সড়ক দিয়ে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) শাহীন চাকলাদারের ভাই শামীম চাকলাদার এই সেতু নির্মাণের ঠিকাদার ছিলেন।
তাদের দাবি, যশোর-৫ আসনের (মনিরামপুর) এমপি ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের অনুসারী শ্যামকুড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনের সহযোগিতায় দায়সারাভাবে সেতুটির কাজ শেষ করেছেন ঠিকাদার। বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা লোপাট হওয়ায় উদ্বোধনের পরপরই সেতুতে ধস নেমেছে।
দায়সারাভাবে সেতুর কাজ করার সময় স্থানীয়রা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; তখন শাহীন চাকলাদার ও চেয়ারম্যান আলমগীরের ভয় দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে চিনাটোলা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ৬ অক্টোবর সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ঠিকাদার নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে নির্ধারিত মেয়াদের এক বছরের বেশি সময় পর দায়সারাভাবে সেতুর কাজ শেষ করেছেন।
সেতুর পূর্ব পাশের বাসিন্দা আজিজুর রহমান বলেন, সেতু খুলে দেওয়ার চার-পাঁচ মাসের মাথায় পাটাতনের পলেস্তারা ফেটে নদীতে পড়ে কয়েকটি গর্ত সৃষ্টি হয়।
'পরে উপজেলায় খবর দিলে ইঞ্জিনিয়ার অফিসের লোক এসে গর্তগুলো বন্ধ করে দিতে চান। আমরা বাধা দিয়েছি। বলেছি, সেতু ভেঙে নতুন করে করতে হবে। তখন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে আরও লোকজন আসে। আমাদের বাধার মুখে তারা সেতুর পাটাতন ভাঙা শুরু করেন। তবে এখন কাজ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে সেতু দিয়ে চলাচলে আমাদের কষ্ট হচ্ছে,' বলেন তিনি।
ফারুক হোসেন নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, 'সেতুর জন্য আনা রড অনেকদিন ফেলে রেখেছিল। এতে রডে মরিচা পড়েছিল। পরে কিছু রড তুলে নিয়ে যান ঠিকাদার। বাকি রড দিয়ে কোনোরকমে সেতুর কাজ করেছেন। যে মাপের রড ব্যবহার করার কথা, সেটা এখানে করা হয়নি।'
জিয়ারুল গাজী নামে আরেক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, সেতু তৈরির সময় ঠিকাদারের লোকজন দায়সারাভাবে কাজ চালাচ্ছিলেন। তারা অন্য এলাকা থেকে সিমেন্ট ও বালু মিশিয়ে ট্রাকে করে এনে ঢালাই দিয়েছেন।
'যতটুকু মোটা করে পাটাতন ঢালাই দেওয়ার কথা ছিল, সেই নিয়মে ঢালাই দেওয়া হয়নি। এখন সেতুর পাটাতন ভাঙার সময় হাতুড়ির আঘাতে ধুলো উড়ছে। পায়ের আঙুল দিয়ে খোঁচা দিতেই খণ্ড খণ্ড ইট-বালু উঠে আসছে। এছাড়া সেতুর মাঝের অংশ নিচের দিকে চাপা। একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে পানি জমে,' বলেন তিনি।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলমগীরের লোকজন সেতুর কাজ চলার সময় উপস্থিত থাকতেন বলে জানান জিয়ারুল গাজী। তিনি বলেন, 'কাজে অনিয়ম দেখে বাধা দিতে গেলে শাহীন চাকলাদার ও আলম চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলা হতো। তখন ভয়ে আমরা চুপ হয়ে যাই।'
সেতুপাড়ের চা দোকানদার আব্দুর রহমান বলেন, সেতুর পূর্ব পাশে উদ্বোধনের একটি নামফলক স্থাপন করা আছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের সেতু উদ্বোধন করার কথা ছিল।
'কিন্তু তিনি উদ্বোধন করতে আসেননি। নামফলকে উদ্বোধনের যে তারিখ দেওয়া আছে, তারও ২০-২২ দিন পরে এসে নামফলক লাগানো হয়েছে,' বলেন তিনি।
স্থানীয় ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি লুৎফর গাজী বলেন, 'কাজের অনিয়ম দেখে বাধা দিতে গেলে চেয়ারম্যান আলমগীর আমাকে পাত্তা দেননি। "বিএনপি-জামায়াতের কথা চলবে না" বলে আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা চাই জোড়াতালি দিয়ে নয়, নতুন করে সেতুর কাজ করতে হবে, যাতে আমরা অনেক বছর সেতু ব্যবহার করতে পারি।'
এ বিষয়ে শ্যামকুড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, 'স্থানীয়দের অভিযোগ সত্যি না। ক্ষোভ থেকে এখন তারা অনেক কথা বলছেন।'
সেতু নির্মাণের ঠিকাদার শামীম চাকলাদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমার লাইসেন্সে অন্য একজন ঠিকাদার কাজ করেছেন। পাটাতন ঢালাইয়ের সময় অন্য জায়গার সিমেন্ট-বালু মিশিয়ে এনে কাজ করা হয়েছে। এতে উপাদানের স্থায়িত্ব কমে যাওয়ায় এমনটি হতে পারে।'
তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু আমার লাইসেন্সে কাজ করা হয়েছে, তাই পাটাতন ধসে পড়ার দায় আমার ওপর বর্তায়। পাটাতনের কাজ নতুনভাবে করা হবে।'