চট্টগ্রামের মেয়র মহিউদ্দিন উড়াল সড়কে নেই শৃঙ্খলা
দু'মাস আগে চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে 'মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ের' পরীক্ষামূলক যান চলাচল শুরু হলেও– সেখানে কোন তদারকি নেই। ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই উড়াল সড়কে বেপরোয়া গতিতে চলে যানবাহন। দুই চাকা ও তিন চাকার যান চলাচল নিষেধ থাকলেও মানছে কেউ। ফলে শৃঙ্খলা আনতে পারছে না বাস্তবায়নকারী সংস্থা- চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
চট্টগ্রামের অক্সিজেন এলাকার বাসিন্দা মোটরসাইকেল আরোহী সাজ্জাদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "আক্তারুজ্জামান ফ্লাইওভারে (মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার ফ্লাইওভার) প্রায় রাতে উল্টো দিক থেকে গাড়ি আসতে দেখা যায়। উল্টো দিক থেকে গাড়ি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠে। ওইদিন একটি বাইক দুর্ঘটনার শিকার হতেও দেখেছি।"
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সাড়ে ৯ মাস পর চলতি বছরের ২৪ আগস্ট থেকে প্রাথমিকভাবে প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস চালু করা হয়। সাময়িকভাবে যান চলাচল শুরু হলেও আপাতত বাস, ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের অনুমতি নেই। এক্সপ্রেসওয়েতে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ কিলোমিটার।
তবে টোল আদায় ও পুরোদমে চালুর বিষয়ে এখনো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া যায়নি। উড়াল সড়কটিতে দুই ও তিন চাকার বাহান চলাচল নিষেধ থাকলেও— হরদমে চলছে। উড়াল সড়কে দাঁড়ানো নিষেধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। আর এসব তদারকিরও কেউ নেই।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছি। নিষেধ করেছি। কিন্তু, কেউ শুনতে চান না। ট্রাফিক বিভাগকে সহযোগিতার জন্য চিঠি দেওয়া হবে।"
আনুষ্ঠানিকভাবে চালুর বিষয়ে তিনি বলেন, "সোমবার (২৭ অক্টোবর) বোর্ড সভায় টোল হার পুনঃনির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এরপর তা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে আনুষ্ঠানিকভাবে টোল সংগ্রহ শুরু হবে।"
সিডিএর তথ্যমতে, গত বছরের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরের 'মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে' উদ্বোধন করেছিলেন। ওই দিন সারা দেশে ১৫৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছিল।
তবে এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের (মূল উড়ালসড়ক থেকে ওঠানামার পথ) কাজ শেষ না হওয়ায় গাড়িগুলো নগরের লালখান বাজার থেকে সরাসরি পতেঙ্গা পর্যন্ত যাতায়াত করছে। নগরীর লালখান বাজার থেকে গাড়ি ওঠার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর এই প্রান্তে গাড়ি নামছে টাইগারপাসে। আর পতেঙ্গা প্রান্তে গাড়ি ওঠানামা করছে।
এক্সপ্রেসওয়ের মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে গত এপ্রিলে। তখন থেকে যান চলাচলের উপযোগী হয়ে যায় এক্সপ্রেসওয়ে; কিন্তু সড়কবাতি, ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপনের কাজ বাকি থাকায় তখন গাড়ি চলাচল শুরু হয়নি।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যৌথভাবে কাজ করছে বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও চীনের র্যাঙ্কিন। এই এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন অংশে ১৫টি র্যাম্প (গাড়ি ওঠা-নামার পথ) রয়েছে। মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হলেও এখনো র্যাম্পের কাজ সম্পন্ন হয়নি। তার আগেই এই প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় অভিযোগ তদন্ত এবং নির্মাণকাজের গুণগত মান যাচাইয়ে গত ১০ জুন একটি উপকমিটি গঠন করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এতে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফকে আহ্বায়ক, বগুড়া-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. মজিবুর রহমান এবং সংরক্ষিত আসনের সাবেক সদস্য পারভীন জামানকে সদস্য করা হয়। উপকমিটি গত ৪ জুলাই থেকে তিন দিনের সফরেও ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। তবে সরকার পতনের পর তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৭ সালের ১১ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। এখন ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। খরচ বেড়েছে ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা।
২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সংশোধিত প্রকল্পটি একনেকের সভায় অনুমোদিত হয়। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু, কাজই শুরু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। পরে দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে যাতায়াতে মোটরকারের জন্য ৫০ থেকে ৮০ টাকা টোল নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল সিডিএ। তবে মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করেছে ১০০ টাকা। বাসের ক্ষেত্রে সিডিএর প্রস্তাব ছিল ওঠা–নামার স্থানভেদে ২৫০ ও ২৮০ টাকা। মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করেছে ৩০০ টাকা। কাভার্ড ভ্যানের জন্য সিডিএর প্রস্তাব ৪৫০ টাকা আর মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করেছে ৫০০ টাকা।