ক্ষমতার পালাবদলের পর খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক ও এনবিএফআই-এর মামলার হিড়িক
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের (এনবিএফআই) দেশের অর্থঋণ আদালতগুলোয় দায়ের করা মামলার সংখ্যা বেড়েছে। আদালতসূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ৩০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রায় চার হাজার ৮২৩টি মামলা দায়ের হয়েছে।
আদালতের কর্মকর্তারা বলছেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি সংখ্যক মামলা দায়ের একটি রেকর্ড। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি–জুলাই) আদালতগুলোতে মোট চার হাজার ৬০০টি মামলা দায়ের হয়েছে। ২০২৩ সালে মোট মামলা দায়ের হয়েছিল নয় হাজার ৮৪৫টি।
ব্যাংক ও এনবিএফআই কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১৫ বছরে বড় মাপের খেলাপি ঋণের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেনি ব্যাংকগুলো।
৫ আগস্ট ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে ব্যাংক ও এনবিএফআই এখন খেলাপি ঋণ আদায়ে আগের তুলনায় বেশি মামলা দায়ের করছে বলে জানান তারা।
তবে কর্মকর্তারা বলছেন, সীমিত সংখ্যক আদালত এবং অপর্যাপ্ত জনবল থাকার কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে ও খেলাপি ঋণ আদায়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বিলম্ব হচ্ছে।
সূত্র জানায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে এক হাজার ১৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আর ২০২৩ সালে নিষ্পত্তি হয়েছিল তিন হাজার ৩৬৭টি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মামলা দায়েরের সংখ্যা বেড়েছে। তাই দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে।'
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল টিবিএসকে বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে অর্থঋণ আদালতগুলোকে মামলা কার্যক্রম দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া, অর্থঋণ আদালত সংখ্যা বৃদ্ধি, দক্ষ বিচারক ও জনবল বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের।'
তিনি আরও বলেন, 'আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ব্যাংকখাত থেকে অনেক টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এ অপরাধীদের বিরুদ্ধে এখন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে।'
রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব
'অজন্তাবিডি লিমিটেড' নামক একটি কোম্পানির কাছ থেকে ৮১১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৩-এ মামলা করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক।
ব্যাংকের আইনজীবী তাবারুল হক টিবিএসকে বলেন, '[কোম্পানিটির] চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রইস উদ্দিন খান ব্যাংক কর্মকর্তাদের কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার ভায়রা ভাই হিসেবে পরিচিত ছিলেন।'
তিনি আরও বলেন, 'তিনি [রইস উদ্দিন] বিভিন্ন সময়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে ব্যাংকে ফোন দিয়ে বা প্রভাবশালীদের দিয়ে ঋণ রিসিডিউল [পুনঃতফসিল] করিয়েছেন।'
এ আইনজীবী আরও জানান, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ব্যাংক এতদিন তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেনি। 'তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হওয়ায় ব্যাংক এখন আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছে।'
আগামী ১৬ নভেম্বর এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে বলে জানান তাবারুল হক।
রইস উদ্দিনকে টিবিএস-এর পক্ষ থেকে ফোন করা হলে তার ব্যবহৃত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
তবে অজন্তা মেশিনারিজের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, রইস উদ্দিন গত জুলাই মাস থেকে দেশের বাইরে আছেন।
অন্যদিকে, প্রায় ৪০৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে টানাকা গ্রুপের 'মারহাবা সিনথেটিক মিলস লিমিটেড'-এর বিরুদ্ধে গত ২৯ আগস্ট ঢাকার অর্থঋণ আদালত-১ এ মামলা করেছে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখা।
সমন প্রদান সংক্রান্ত নোটিশ পত্রিকায় প্রকাশ করে আদালত ১০ নভেম্বর বিবাদীকে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন।
টানাকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মহিউদ্দিন মাহিন টিবিএসকে বলেন, 'আদালতে মামলা হয়েছে, আমরা এর বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছি। আইনগতভাবে মোকাবিলা করা হবে।'
তিনি বলেন, কারখানা প্রতিষ্ঠার পর ঋণ নিলেও উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি গত ১৪ বছরে। 'ঋণ নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিদর্শনের পর এটিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কোম্পানি হিসেবে চিহ্নিত করে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।'
'ফলে ব্যাংকের টাকা বিনিয়োগ করে উৎপাদনে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে,' তিনি আরও বলেন।
আদালতে বাড়ছে মামলার চাপ
দেশে বর্তমানে ৬৭টি অর্থঋণ আদালত রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি জেলায় একটি এবং রাজধানী ঢাকায় চারটি আদালত রয়েছে।
আদালতসূত্রে জানা গেছে, আগস্ট থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার ৪টি অর্থ ঋণ আদালতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার দুই হাজার ৩৫৩টি মামলা দায়ের হয়েছে।
ঢাকার ৪টি অর্থঋণ আদালতে বর্তমানে প্রায় ৩৪ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যার সঙ্গে জড়িত প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৪-এর সেরেস্তাদার নুরুল হুদা টিবিএসকে বলেন, 'আগে প্রতিমাসে গড়ে ৭০–৮০টি মামলা দায়ের হতো, কিন্তু আগস্ট থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত ৭৭৬টি মামলা দায়ের হয়েছে।'
সুপ্রিম কোর্টসূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে বর্তমানে সবগুলো অর্থঋণ আদালতে প্রায় ৭৬ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
গত জুন পর্যন্ত দেশের অর্থঋণ আদালতে মোট মামলার সংখ্যা প্রায় ৭২ হাজার ছুঁয়েছে, যার সঙ্গে জড়িত প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।
এর মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে। হাইকোর্টের আদেশে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের একজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ের সর্বশেষ আইনগত উপায় হলো অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের। যদি কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়, তবে তার নাম ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত হয়।
এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ এ. (রুমি) আলী টিবিএসকে বলেন, অর্থঋণ আদালতে বিচারক এবং জনবলের ঘাটতির কারণে মামলা নিষ্পত্তি দীর্ঘসূত্রিতায় পড়ে।
তিনি বলেন, 'ব্যাংকের টাকা দ্রুত আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে বিচারক ও জনবলের উপস্থিতি নিয়মিত করা প্রয়োজন। এছাড়াও, এসব মামলার বিচারকার্য কতদিনের মধ্যে শেষ হবে, সে বিষয়ে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত।'
তিনি আরও পরামর্শ দেন, 'যারা উচ্চ আদালতে গিয়ে অর্থঋণ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে রিট করেন, তাদের ক্ষেত্রে রিট করার আগে মোট ঋণের একটি অংশ জমা দেওয়ার আইনগত ব্যবস্থা করা উচিত।'
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, 'উচ্চ আদালতে রিট করে এসব মামলার কার্যক্রম স্থগিতের একটি প্রবণতা রয়েছে। এটির একটি যৌক্তিক সমাধানে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করা হবে।'