আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তি ছিল মিথ্যাচার, ভয়ের পরিবেশ আর উন্নয়ন আচ্ছন্নতা : দেবপ্রিয়
অর্থনীতিসংক্রান্ত শ্বেতপত্র প্রণয়ন জাতীয় কমিটির প্রধান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরাচারী শাসন ৩টি মূল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ছিল—মিথ্যা বয়ান, ব্যাপক ভয়ের পরিবেশ, এবং উন্নয়ন আচ্ছন্নতার মডেল।
তিনি বলেন, '৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ ও ছাত্ররা আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটায়। আমরা দেখেছি কীভাবে তীব্র মিথ্যা বয়ান, ব্যাপক ভয়ের পরিবেশ ও উন্নয়ন আচ্ছন্নতার মডেল একটি স্বৈরাচারী শাসনকে টিকিয়ে রাখে।'
সোমবার (১৮ নভেম্বর) প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ আয়োজিত 'বে অব বেঙ্গল কনভার্সেশন' অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
দেবপ্রিয় বলেন, 'মিথ্যার সূচনা কোথা থেকে? এটি শুরু হয় নেতার জীবনী থেকে, যেখানে একটি "মেসিয়া কমপ্লেক্স" গড়ে তোলা হয়। এরপর তা পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে দেশের ইতিহাসে মিশে যায়। এভাবেই মিথ্যার বিস্তার ঘটে এবং বিরুদ্ধমতের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ অপবাদ ছড়িয়ে দেওয়া হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'মিথ্যা এখানেই থেমে থাকে না। যে সমস্ত পরিসংখ্যানের ওপর দেশের পরিচালনা নির্ভর করে, সেগুলোকেও শেষ পর্যন্ত বিকৃত করা হয়। এসব সংখ্যা হলো নির্বাচনের ফলাফল, বিনিয়োগের পরিসংখ্যান, কর্মসংস্থানের হার এবং জিডিপি ও প্রবৃদ্ধির হিসাব।'
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো দেবপ্রিয় বলেন, ভীতির কারণগুলো ছিল অনেক গভীর। 'ভীতি এমন যে, আপনি একদিন কিছু বললে, গোপন কোনো সংস্থা আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে, আর আপনার পরিবার আপনাকে খুঁজে পাবে না। এটি বাংলাদেশে "আয়নাঘর" নামে পরিচিত। তাই ভীতি হলো স্বৈরাচারী শাসনের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।'
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে—একটি হলো দমন, অন্যটি হলো বর্জন। 'আপনার দেশে বহুত্ববাদী মতাদর্শগুলোকে দমন করা হয় এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সক্ষম স্টেকহোল্ডারদের বাদ দেওয়া হয়।'
দেবপ্রিয় বলেন, 'মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে তৈরি সমৃদ্ধির বিভ্রম হলো, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে কিছু উন্নয়ন বিতরণ করা, যাতে তাদের পাশে রাখা যায়।'
তিনি বলেন, 'সমস্যা শুরু হয় ক্রোনি ক্যাপিটালিজম দিয়ে, কিন্তু এটি শেষ হয় অলিগার্কদের উত্থানের মাধ্যমে। এসব অলিগার্ক এমন মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী, যাদের রাজনীতিবিদরা মনে করেন তারা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু একদিন দেখা যায়, অলিগার্করাই রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এ ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন মোটেই অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়। এটি অসমতা এবং প্রান্তিককরণের ওপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়।'
'দিনশেষে শুধু বিনিয়োগই নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় বহনের মতো যথেষ্ট সম্পদও থাকে না,' বলেন তিনি।
দেবপ্রিয় আরও অভিযোগ করেন, অতীতে এমন ব্যক্তিদের সরকারি চাকরি দেওয়া হয়েছে, যারা মূলত দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়।
'ফলে শিক্ষার মান এবং কর্মসংস্থানের ঘাটতি একটি টাইম বোমার মতো হয়ে উঠেছিল, যা শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটিয়েছে,' বলেন তিনি।