চট্টগ্রাম নগরীর বাইরে প্রথমবারের মতো ওয়াসার পানি সরবরাহ শুরু চলতি মাসেই
প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম নগরীর বাইরে পানি সরবরাহ করতে যাচ্ছে ওয়াসা। নতুন ভাণ্ডালঝুড়ি প্ল্যান্ট থেকে প্রতিদিন ৬ কোটি লিটার পানি উৎপাদন শুরু হবে এই মাসের শেষের দিকে।
এই প্ল্যান্ট থেকে বোয়ালখালী, পটিয়া, কর্ণফুলী এবং আনোয়ারা উপজেলার শিল্প ও আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহ করা হবে। এর ফলে পানি উৎপাদনের সক্ষমতা ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিদিন ৫৬০ মিলিয়ন লিটার (এমএলডি) হবে।
ভাণ্ডালঝুড়ি পানি সরবরাহ প্রকল্প ২০১৫ সালের জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায় এবং ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়।
প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ১,০৩৬.৩০ কোটি টাকা ধরা হলেও, তা দুই ধাপে তা বেড়ে ১,৯৯৪.১৪ কোটি টাকায় পৌঁছায়।
প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহাবুবুল আলম টিবিএস-কে বলেন, "প্রকল্পের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৮৫ শতাংশ। বর্তমানে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চলছে। পাইপলাইনে পানি সরবরাহ, লিকেজ বা সমস্যা থাকলে তা সমাধান করা হচ্ছে। চলতি মাসের (নভেম্বর) শেষে উৎপাদন শুরু হবে।"
এই প্রকল্পের অধীনে ৬৬ এমএলডি ধারণক্ষমতার ইনটেক সুবিধা, ৬০ এমএলডি (৬ কোটি লিটার) পানি শোধনাগার, ১৩৩.৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন এবং পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আনোয়ারায় ১০ হাজার ঘনমিটার ধারণক্ষমতার একটি ভূগর্ভস্থ জলাধার এবং পটিয়ায় ৩ হাজার ঘনমিটার ধারণক্ষমতার একটি ওভারহেড জলাধার অন্তর্ভুক্ত।
প্রকল্পের অর্থায়নে দক্ষিণ কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকের ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড থেকে ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা ঋণ, বাংলাদেশের সরকার থেকে ৭৫০.১৪ কোটি টাকা এবং চট্টগ্রাম ওয়াসার নিজস্ব তহবিল থেকে ২০ কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত।
শিল্প এবং আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহ
এই প্রকল্পের লক্ষ্য, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত শিল্পাঞ্চল এবং আবাসিক এলাকার ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা পূরণ করা।
উৎপাদিত ৬০ এমএলডি পানির মধ্যে ৫ কোটি লিটার বরাদ্দ করা হবে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো), চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) এবং ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ফার্টিলাইজার কোম্পানির মতো সার কারখানা, চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলসহ শিল্পাঞ্চল এবং পর্যটন কেন্দ্রগুলোর জন্য।
সিইউএফএল-এর দৈনিক ২০ এমএলডি, কাফকোর ১০.৫ এমএলডি, ডিএপি ফার্টিলাইজার কারখানার ১.২ এমএলডি এবং চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও কোরিয়ান অর্থনৈতিক অঞ্চলের যথাক্রমে ৩০ এমএলডি এবং ২০ এমএলডি পানির চাহিদা রয়েছে।
শিল্প ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলমান রয়েছে এবং সিইউএফএল ও ডিএপি ফার্টিলাইজার কারখানায় পানি সরবরাহ শীঘ্রই শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়াও, প্রায় ১৫ হাজার আবাসিক সংযোগে প্রতিদিন ১ কোটি লিটার লিটার পানি সরবরাহ করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুল আলম আরও বলেন, "শুরুতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক গ্রাহককে পানি সরবরাহ করা শুরু হবে এবং চাহিদার ওপর ভিত্তি করে উৎপাদন ধীরে ধীরে বাড়ানো হবে," ।
উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও, প্রকল্পটি কিছুটা বিলম্বের সম্মুখীন হয়েছে।
প্রকল্পটি প্রাথমিকভাবে ২০২৩ সালের জুনে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। তবে কর্ণফুলী নদীর নিচে একটি পাইপলাইন নির্মাণে টানেল বোরিং মেশিন (টিবিএম) ব্যবহার করার কারণে জটিলতা দেখা দেয় এবং সময়সীমা ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে টিবিএম নদীর ২০২ মিটার পার করার সময় ৭৮ ফুট গভীরে আটকে যায়। মেশিনটি উদ্ধার করার প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়, কারণ কাছাকাছি একটি পুকুরের জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণে উদ্ধার কাজ থেমে যায়।
ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণ
বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসা ৯১ হাজারের বেশি সংযোগের মাধ্যমে ৩২ লাখ মানুষকে সেবা দিচ্ছে, যার ৯৩ শতাংশ আবাসিক সংযোগ।
সংস্থাটির দৈনিক পানি উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ কোটি লিটার। এরমধ্যে শেখ রাসেল পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে দৈনিক ৯ কোটি লিটার, শেখ হাসিনা পানি শোধনাগার প্রকল্প ০১ ও ০২ থেকে ১৪.৩ কোটি লিটার করে মোট ২৮.৩ কোটি লিটার এবং মোহরা পানি সরবরাহ প্রকল্প থেকে ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা হয়। এছাড়া গভীর নলকূপ থেকে আসে ৪ কোটি লিটার পানি।
ভাণ্ডালঝুড়ি প্ল্যান্ট চালু হলে এর উৎপাদন ক্ষমতা ৬ কোটি লিটার বৃদ্ধি পাবে। তবে, ২০৩২ সালের মধ্যে চাহিদা ৭০ কোটি লিটার এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ১২২ কোটি লিটার হতে পারে।
ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম ব্যাখ্যা করেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুষ্ক মৌসুমের লবণাক্তার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে শিল্প কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়। এই প্রকল্পটির লক্ষ্য এই সমস্যাটি সমাধান করা এবং ভবিষ্যতের পানি শোধনাগারের জন্য জমি সংরক্ষণ করা। ভাণ্ডালঝুড়ি থেকে পানি শুধু কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরের এলাকায় সরবরাহ করা হবে, শহরের জলাধারের সাথে কোনো সংযোগ থাকবে না।"
এই সম্প্রসারণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ওয়াসা শিল্পের অগ্রগতি এবং আবাসিক চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চায়। পাশাপাশি পানি ব্যবস্থাপনাযর সাথে সম্পর্কিত জলবায়ু চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে খাপ খাওয়াতে চায়।