আগামী মার্চের আগে ১১–কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চায় যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শ্রম অধিকার নিয়ে যে ১১টি কর্মপরিকল্পনা দিয়েছে— তার বাস্তবায়ন আগামী বছরের মার্চের আগেই দেখতে চায় দেশটি।
গতকাল সোমবার (২৫ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক শ্রমবিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিশেষ প্রতিনিধি কেলি এম. ফে রদ্রিগেজ বাংলাদেশের শ্রম সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সাথে এক বৈঠকে এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিনিধিদলকে জানান, তার অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে আরও বিদেশি বায়ারদের (ক্রেতা) আকৃষ্ট করতে দেশে ব্যাপক শ্রমসংস্কারের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মার্কিন প্রতিনিধিদল তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, 'আমরা আমাদের শ্রম আইনগুলোকে বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে চাই। এটি আমাদের প্রতিশ্রুতি।' এমনটিই জানানো হয়েছে এক প্রেস বিবৃতিতে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের শ্রম আইন সংস্কার এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার গোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর এ সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্বেগ সমাধানে একজন বিশেষ দূত নিয়োগ দিয়েছে।
এ সময় মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার এর ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি থিয়া মেই লি এবং কেলি ফে রদ্রিগেজ।
বৈঠকে মার্কিন কর্মকর্তারা মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে গার্মেন্টস ও পাদুকা শ্রমিকদের বাঁচাতে কারখানায় ইউনিয়ন অধিকার ও প্রতি বছর তাদের মজুরি পর্যালোচনার আহ্বান জানান।
ড . ইউনূসও এ সময় বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোকে প্রতি জানুয়ারিতে তাদের অর্ডারের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান, যাতে বাংলাদেশের উৎপাদকরা সেই অনুযায়ী শ্রমিকের মজুরি বাড়াতে পারেন।
শ্রম মন্ত্রণালয়ে বৈঠক
এ বৈঠকেও আমেরিকান বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন শ্রম সচিব।
গত এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শ্রম খাতের উন্নয়নে ১১ দফা অ্যাকশন প্লান দিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে— ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করা, কর্মপরিবেশ উন্নত করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রতি বছর বছর ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা, ইপিজেড ও ইপিজেডের বাইরে একই শ্রম আইন চালু করা ইত্যাদি।
এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, "মার্কিন প্রতিনিধি দল তাদের সুপারিশ করা ১১ পয়েন্টের বাস্তবায়ন দেখতে চায়। স্বচ্ছতার সাথে বাস্তবায়ন চায়। কারণ তাদের দেশের করদাতারা, অর্থাৎ যারা বাংলাদেশে তৈরি করা পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য কিনছেন, তারা জানতে চান বাংলাদেশে শ্রমখাতে আন্তর্জাতিক মান কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে।"
তিনি বলেন, "শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রতিনিধি দলকে ইতোমধ্যে নেওয়া উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জানানো হয়েছে। বিশেষ করে মালিক, শ্রমিক ও সরকারের সমন্বয়ে করা ১৮–দফা সম্পর্কে তাদের জানানো হয়েছে। এই ১৮–দফার মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আইএলও, জার্মান ও জাপানের করা সুপারিশগুলো রয়েছে। বাংলাদেশের উদ্যোগে মার্কিন প্রতিনিধি দল সন্তুষ্ট। আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে তারা সহযোগিতাও করতে চায়।"
শ্রম সচিব আরও বলেন, "আমরা তাদের (মার্কিন প্রতিনিধি দল) জানিয়েছি যে, আগামী তিন মাসের মধ্যে দু–একটি ছাড়া বেশিরভাগ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। যেসব বিষয় বাস্তবায়ন হবে না, সেগুলো বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সমর্থন করে। কিন্তু বাস্তবায়নে সময় লাগবে।"
"বিশেষ করে ইপিজেড ও ইপিজেডের বাইরে অভিন্ন শ্রম আইন বাস্তবায়ন করার বিষয়টি। কারণ ইপিজেডগুলোতে বিদেশি উদ্যোক্তারা ইপিজেড আইনসহ অন্যান্য বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে দেশে বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। এরপরও থার্ডপার্টিকে দিয়ে একটি স্টাডি করে দেখার সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, অভিন্ন আইন করা হলে তার সামাজিক প্রভাব কী হতে পারে।"
তিনি বলেন, "সরকার একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নীতিমালা করার পরিকল্পনা করছে। বর্তমান নীতিমালায় ৫ বছর পরপর মজুরি হালনাগাদ হয়। নতুন নীতিমালায় প্রতিবছর হালনাগাদ করা যায় কিনা তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।"
শ্রম সচিব বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দল ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন সহজ ও দ্রুত করার বিষয়ে সুপারিশ করেছে। তাদেরকে জানানো হয়েছে, এর আগে ৬০ দিনের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন দেওয়ার নিয়ম ছিল, সেটা কমিয়ে এখন ৫৫ দিন করা হয়েছে। একইসাথে প্রতিনিধি দল একটি কারখানার ১০ শতাংশ শ্রমিকের স্বাক্ষর হলেই ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন দেওয়ার সুপারিশ করেছে। তাদেরকে জানানো হয়েছে, আইনে রয়েছে ২০ শতাংশ শ্রমিকের স্বাক্ষরে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন করতে হবে। সেটি এখন কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এ সময় একজন সাংবাদিক শ্রম সচিবকে প্রশ্ন করেন, ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধনে মালিকপক্ষের হস্তক্ষেপ রয়েছে। যে কারণে সকল ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে আবেদনকারী শ্রমিকপক্ষকে হয়রানিতে পড়তে হয়। এসব সমস্যা সমাধানে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
জবাবে শ্রম সচিব বলেন, এ অভিযোগ বিষয়ে তিনি অবগত। আগামীতে যাতে এ ধরনের অভিযোগ না আসে, সেজন্য ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন পদ্ধতি অনলাইনে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
"ইতোমধ্যে একটি সফটওয়্যার কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আবেদনকারীরা অনলাইনে আবেদন করবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধন পাবেন। কাউকে ফিজিক্যালি এসে আবেদন করতে হবে না, আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংয়েরও সুযোগ থাকবে না," বলেন শ্রম সচিব।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, মার্কিন প্রতিনিধি দল শ্রম সংগঠনকে কালো তালিকাভুক্ত করা, মামলা, তদন্ত এবং চলমান শ্রম অস্থিরতা নিয়ে আলোচনা করেছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, বর্তমান সরকার চলমান শ্রম অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়গুলোও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। কোথাও কোনো অহেতুক মামলা হবে না।
সফিকুজ্জামান বলেন, "এই পরিস্থিতিগুলোর উন্নতি সরকার, ব্যবসায়ী ও শ্রম প্রতিনিধিরা চান। কারণ এসব কাজ করা হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা নায্যমূল্য চাইতে পারবেন। এতে শ্রমের মজুরি বাড়ানো যেমন সহজ হবে— তেমনি কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তাসহ শ্রমিকদের অন্যান্য সুবিধা দেওয়াও সহজ হবে।"
তিনি বলেন, সরকার বর্তমানে শ্রমিক, উদ্যোক্তা, ক্রেতা সকলের আস্থা অর্জনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে।
"তবে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার, নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছে। মানবাধিকার একটা অনেক ব্যাপক বিষয়। তাদের জানানো হয়েছে, সামগ্রিকভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকার কাজ করছে," বলেন তিনি।
শ্রম সচিব বলেন, "বাংলাদেশের অনেক কারখানাতে সমস্যা আছে এটা সত্য। তবে কারখানাগুলো বন্ধ করা যাবে না। অনেক কারখানায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার কর্মী আছেন। এজন্য ব্র্যান্ড বায়ারদের বলা হয়েছে যে, কারখানাগুলো চালিয়ে নিতে হবে। কোনো প্রফিট দিতে হবে না। বেক্সিমকোর শ্রমিকদের বেতন সরকার ঋণ দিয়ে পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে। এভাবে তো বেশিদিন চালানো যাবে না।"