যেভাবে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো অপহরণ ও গুম কার্যক্রম চালাতো
গুম সংস্কৃতি বা অপহরণ ও গুমের প্রথা গত ১৫ বছরে গড়ে উঠেছে। আর এগুলো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে বিষয়গুলো ভাবাও যেত না।
গতকাল শনিবার গতকাল (১৪ ডিসেম্বর) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে অপহরণ ও গুম বিষয়ক তদন্ত কমিশন। প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে গুম ও অপহরণ বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী প্রায়ই সাদামাটা পোশাক পরত এবং তাদের কার্যক্রম অন্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর চাপানো হতো। যেমন- ডিজিএফআই কাজ করতো র্যাবের পরিচয় ব্যবহার করে এবং র্যাব কাজ করতো ডিবি পরিচয়ে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাহিনীগুলো নিজেদের মধ্যে শিকার ভাগাভাগি করে নিতো। দেখা যায়, এক বাহিনী অপহরণ করত, অন্য বাহিনী তাদের আটক করতো এবং তৃতীয় কোনো বাহিনী হত্যা বা মুক্তির সঙ্গে জড়িত থাকতো।
কমিশন প্রতিবেদনে একটি উদাহরণ তুলে ধরে বলেছে, "এক ভুক্তভোগীর কল রেকর্ড থেকে জানা যায়, তাকে অপহরণ করার পরই তার সিম কার্ডটি ডিজিএফআই সদর দপ্তরে সক্রিয় করা হয়। যদিও তার বর্ণনা অনুযায়ী তাকে শুরুতে এক সেলে আরও আটককৃতদের সঙ্গে রাখা হয়েছিল। তাই ধারণা করা হয় তাকে প্রথমে ডিজিএফআইয়ের জেআইসিতে আটকে রাখা হয়। তবে পরবর্তীতে তাকে র্যাবের বিভিন্ন কারাগারে আটক অবস্থায় পাওয়া গেছে। পরে মাসখানেক পর র্যাব ৭-এর পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, "এ অবস্থায় একজন বেঁচে থাকা ব্যক্তি যদি ফিরে আসে তাহলে এর জন্য দায়ী সংস্থাকে তা চিহ্নিত করাও কঠিন হয়ে পড়ত।"
সেখানে আরও বলা হয়েছে এসব অপারেশনগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বিভক্ত করা হতো। ফলস্বরূপ, যারা সরাসরি হত্যা বা গুমের সঙ্গে যুক্ত, তারা প্রায়ই জানতো না কারা তাকে হত্যা করেছে কিংবা এ অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য বা প্রেক্ষাপট কি ছিল।
তবে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীল কর্মকর্তাদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এসব তথ্য ভালোভাবেই জানতেন। প্রতিবেদন অনুসারে, দলগুলোর ঘন ঘন পরিবর্তন, আঞ্চলিক সীমারেখাগুলোর মিশ্রণ এবং সুস্পষ্ট অপারেশনাল সীমানার অভাব গোপন অপরাধের প্রকৃতিকে আরও জটিল করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, র্যাব ২ সহজেই র্যাব ১১-এর এলাকায় ঢুকে অপারেশন চালাতে পারতো এবং এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উঠতো না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া অধিকাংশ গুমের জন্য র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব), ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমসকে (সিটিটিসি) দায়ী করা হয়েছিল। কমিশনকে দেওয়া ভুক্তভোগী, সাক্ষী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা তাদেরই প্রধান অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
গুমের ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরও কিছু সংস্থা, যেমন ডিরেক্টোরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইনটেলিজেন্স (ডিজিএফআই) এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলিজেন্সও (এনএসআই) অভিযুক্ত হয়েছে।
তদন্ত কমিশন প্রতিবেদনে বলেছে, "অপহরণ ও গুম নিয়ে গড়ে ওঠা এ সিস্টেমের প্রকৃতি তদন্তের কাজকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং করে তুলছে। কারণ এগুলো করাই হয়েছিল বিশেষভাবে দায়িত্ব চাপানোর জন্য এবং জবাবদিহিতা এড়ানোর জন্য।
কমিশন জীবিত ভুক্তভোগীদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। তারা জানিয়েছে, "জীবিত ভুক্তভোগীরা যারা আমাদের কাছে এসেছেন, তাদের মাধ্যমেই আমরা এ সিস্টেমের এতো কিছু বের করতে পেরেছি। তাদের কাছে আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো।"