পুলিশের তথ্যে দেশে নারী-শিশু নির্যাতন কমার দাবি, একমত নন মানবাধিকার কর্মীরা
বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় বিগত পাঁচ বছরে ১ লাখের বেশি মামলা হয়েছে বলে উঠে এসেছে পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে।
পুলিশের পক্ষ থেকে এ তথ্য দেখিয়ে নির্যাতনের ঘটনা কমার দাবি করা হলেও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পুলিশের দেওয়া তথ্যে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি।
পাঁচ বছরের বেশি সময় বন্ধ রাখার পর, সম্প্রতি নতুন পুলিশ কমিনার বাহারুল আলম পুলিশ সদরদপ্তরের ওয়েবসাইটে এ অপরাধ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেন।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে এক লাখ ৭ হাজার ১২৪টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া, দেশে প্রতিদিন ৫৯ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ২০১৯ সালে দেশব্যাপী মামলা হয়েছে ২১ হাজার ৭৬৪টি। তবে করোনাকালে, অর্থাৎ ২০২০ সালে নারী নির্যাতনের হার কিছুটা বেড়ে যায়। সেময় দেশব্যাপী ২২ হাজার ৫১৭টি নির্যাতনের ঘটনার মামলা নথিভুক্ত হয়েছে।
পরবর্তী বছর থেকে ক্রমান্বয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা নথিভুক্ত হওয়ার সংখ্যা কমতে থাকে। ২০২১ সালে ২২ হাজার ১৩৬টি, ২০২২ সালে ২১ হাজার ৭৬৬টি এবং ২০২৩ সালে ১৮ হাজার ৯৪১টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। ৫ বছরের ব্যবধানে মামলার সংখ্যা কমেছে আড়াই হাজারেরও বেশি।
বিভাগগুলোর মধ্যে বিগত ৫ বছরে সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিভাগে ১৭,১৫৯টি মামলা হয়েছে এবং সবচেয়ে কম ৪,৫৭১টি হয়েছে সিলেট বিভাগে।
নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা মেট্রোপলিটন শহরগুলো মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে ঢাকা শহরে। ঢাকা মহানগর এলাকায় গত ৫ বছরের মামলা হয়েছে ১০ হাজার ৪৩০টি। প্রতিদিন নারী নির্যাতনের ঘটনায় ৬টি করে মামলা দায়ের হয়।
অন্যদিকে, সবচেয়ে কম মামলা হয় বরিশাল মহানগরে। বিগত ৫ বছরে এখানে মামলা হয়েছে মাত্র ৮১৩টি।
তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পুলিশের তথ্যে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবরূপ ফুটে ওঠেনি। বিগত সময়গুলোতে দেশে এক দলীয় শাসন ছিল। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অনেকেই ভয়ে নির্যাতনের অভিযোগ করেননি। এছাড়া অনেক সময় ভুক্তভোগী সামাজিক ও পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেছেন, "পুলিশের ডেটা দিয়ে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবচিত্র ফুটে ওঠেনি। স্থানীয় পর্যায়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের অনেক ঘটনায় মামলা হয় না।"
"বিগত ৫ বছরে দেশে একদলীয় শাসন ছিল। সে সময় সরকার দলীয় লোকজন কর্তৃক নারী ও শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলেও ভয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি। এছাড়া, সামাজিকভাবে হেয়পতিপন্ন, ভয়ভীতি ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে থানা অভিযোগ করেন না।''
"অনেক সময় দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন নিয়ে বাইরে ঘুরছেন। অথচ ভুক্তভোগীকে মাসের পর মাস আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ভুক্তভোগী পরিবার বিচারের দাবি না করে স্থানীয়ভাবে মীমাংসার পথ বেঁচে নেয়," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, পুলিশের তথ্যকে সমর্থন করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান বলেছেন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা কিছুটা কমেছে।
তবে, যৌতুকের জন্য স্বামী কর্তৃক নারী নির্যাতনের চিত্র অপরিবর্তিত রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
"নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বশীল বয়স্ক মানুষজন ধামাচাপা দিয়ে দিতো। তবে সম্প্রতি ছাত্ররা আমাদের একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তারা এখন স্থানীয় পর্যায়েও কাজ করছে। এদেরকে যদি দেশের বিভিন্ন স্তরে যুক্ত করা যায়, তবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা কমে আসবে," যোগ করেন সাইদুর রহমান।
নারী উন্নয়ন সংস্থা নারী মৈত্রীর জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট লিড লায়লা আরিফা খানম বলেন, "বিগত কয়েক বছর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু আইনী জটিলতার কারণে থানায় এ ঘটনার কোনো অভিযোগ নেওয়া হয় না। ফলে তা পুলিশের ডেটায় আসে না।"
এদিকে, অ্যাকশনএইড ও ইউএনএ'র সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোর তথ্য বলছে, বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে।
বাল্যবিবাহ একটি ভয়বাহ শিশু নির্যাতন। এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নিয়মিত নারীরা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, কিন্তু আইনে এটি নন-কগনিজিবল অফেন্স হিসেবে উল্লেখ করায় সংশ্লিষ্ট থানাগুলো সরাসরি অভিযোগ বা মামলা গ্রহণ করে না। এর ফলে মামলার সংখ্যা দিয়ে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রকৃত পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা কঠিন বলে অভিমত মানবাধিকার কর্মীদের।