কাজ অনেক, সময় অনেক কম
২০২৫ সালের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মতালিকা আরও দীর্ঘ হয়েছে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই থেকে শুরু করে পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনা; জুলাই গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের শীর্ষ নেতাদের বিচার সম্পন্ন করা; আইনশৃঙ্খলার উন্নতি থেকে শুরু করে অবাধ্য মূল্যস্ফীতিকে বাগে আনা; অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা থেকে শুরু করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো; ব্যাংক খাতের দুর্বল স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বেগবান করা; তার সঙ্গে রাষ্ট্রের ব্যাপক সংস্কারের জন্য জাতীয় ঐক্যমত্ গঠন, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন থেকে শুরু করে অন্যান্য আরও অনেক কাজও রয়েছে—যা এই সরকারকে আগামী বছরে সম্পন্ন করতে হবে।
বলাবাহুল্য, সব মিলিয়ে এ এক কঠিন দায়িত্ব। আর সময়ও বেশ সংক্ষিপ্ত। এই পরিস্থিতিতে, আরও ভালো সম্ভাবনার নতুন বাংলাদেশ গড়তে জনগণের আন্তরিক সমর্থনই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি।
সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ ও প্রশাসন সংস্কারে গঠিত কমিশনগুলো জানুয়ারির শুরুতে তাঁদের সুপারিশগুলো দেবে। তারপর প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যমত্য গড়তে এসব কমিশনের প্রধানদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হবে।
কিছু সংস্কার, যেমন– আর্থিক খাতের দুর্বল স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার এবং অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মাঠ প্রস্তুতের জন্য দরকারি পদক্ষেপ—এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। অন্যান্য সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রও প্রস্তুত করা হবে—যাতে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও সেগুলোর বাস্তবায়ন করা যায়।
অর্থাৎ, নতুন বছর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে অগ্রযাত্রা ও অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফেরানোর এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এই কাজটা মোটেও সহজ হবে না।
সদ্য বিদায়ী বছরের সাথে নতুন বছরের মৌলিক পরিবর্তনগুলো ব্যাপক। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার পতন হয়েছে, কিন্তু এই অভ্যুত্থান বিগত বছরে যে উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছে—নতুন বছরে সেসবের বাস্তবায়ন দেখার আশা অনেক বেশি থাকবে।
আগে কোনটি: সংস্কার না নির্বাচন?
ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত জুলাই অভ্যুত্থানের মূলমন্ত্র নিহিত আছে তাঁদের 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন' প্ল্যাটফর্মের নামেই, আর তা হলো বৈষম্যের অবসান।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এই মূলমন্ত্রকে গ্রহণ করেছে বলেও মনে হচ্ছে। তাই রাষ্ট্রের মূল তিনটি স্তম্ভ—নির্বাহী বিভাগ (এক্সিকিউটিভ), আইন বিভাগ (লেজিসলেটিভ) ও বিচার বিভাগ (জুডিশিয়ারি)—ঠিকঠাক করার এক কঠিন লড়াইয়ে নেমেছে। এর মধ্যে জনজীবনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ছিল নতুন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ। সরকার ধারাবাহিকভাবে বহু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, যা দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত সংস্কারগুলোর মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পুনর্গঠন করতে তাঁদের প্রতিশ্রুতিকে তুলে ধরছে। তবে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করবে কে? অন্তর্বর্তী সরকার নাকি নির্বাচিত নতুন সরকার? অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে? আগে সংস্কার নাকি আগে নির্বাচন?—এ ধরনের আলোচনা আর বিতর্কও এখন উঠছে।
২০২৫ সালের শেষে বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচনের সম্ভাব্য এক সময়সীমা এর মধ্যেই ঘোষণাও করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই ঘোষণা নির্বাচনের বিষয়ে কিছু অনিশ্চয়তা দূর করলেও—২০২৫ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে—তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।
নতুন বছরকে কেন্দ্র করে দেশের ব্যবসায়ীরাও আশা ও উৎকণ্ঠার দোলাচলে রয়েছেন। রেমিট্যান্স ও রপ্তানির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, অর্থপাচার ও ঋণ খেলাপি রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ—এসবই নতুন বছরে আরও ভালো ব্যবসায়িক পরিবেশের আশা জাগায়। তবে মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদহার নিয়ে আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তার চেয়েও বড় উদ্বেগ রয়েছে—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে।
বাস্তবায়নের পক্ষে কাজগুলো অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠছে
বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কখনোই তেমন শক্তিশালী ও কার্যকর ছিল না—কার্যকর গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে যা তাদের হওয়া উচিত ছিল। বিগত সরকারের সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে একেবারেই ভঙ্গুর করে তোলা হয়।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ডিসেম্বরে একটি অনুষ্ঠানে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোগত সমস্যাগুলো 'অব্যবস্থাপনা' সৃষ্টি করেছে—যার ফলে সেগুলো এখন সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
তবে প্রশাসন সংস্কার নিয়ে যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে—তাতেই বোঝা যাচ্ছে কাজটি কত কঠিন হবে।
প্রত্যাশার পারদ যত উঁচুতে, তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের তালিকা কেবল বাড়বে। 'একজন অত্যাচারী শাসককে হটানো এবং আরও উদার সরকার গঠনের পথে এগোনোর জন্য' প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের বর্ষসেরা দেশ নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ।
দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। এটি ছাত্র, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের সমর্থন পেয়েছে। এ সরকার আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে ও অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করেছে।
সাময়িকীটি আরও বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে ২০২৫ সালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করতে হবে। কবে নির্বাচন হবে তা–ও নির্ধারণ করতে হবে। আদালতগুলোর নিরপেক্ষভাবে কাজ করা ও বিরোধী দলগুলোর সংগঠিত হওয়ার সময় পাওয়ার বিষয় প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনোটি সহজ হবে না।
সেই সূত্র ধরেই বলা যায়, ২০২৫ সালে রাজনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য ও জনজীবন কোনোটাই সহজতর হবে না।