‘বাবার কোনো গল্প নেই আমার’: বিডিআর সদস্যের মুক্তির মধ্য দিয়ে কন্যার ১৬ বছরের অপেক্ষা শেষ হলো
বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) বেলা ১১টা। কাশিমপুর কারাগারের প্রধান ফটকে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে ১৬ বছরের তাহসিন আক্তার। চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে।
এর আগেও একাধিকার এই কারাগার প্রাঙ্গণে এসেছে তাহসিন। তবে এবারে পরিস্থিতি একবারে ভিন্ন। কারণ তার বাবা, সাবেক বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদস্য দুলাল মিয়া ১৬ বছর পর জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছেন আজ।
তাহসিনের বয়স যখন মাত্র আট মাস, তখন তার বাবা পিলখানায় ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন।
এখন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহসিন শৈশবের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলে, 'আমার সহপাঠীরা বিভিন্ন সময় তাদের বাবার গল্প করত। কিন্তু বাবার কোনো গল্প ছিল না আমার। কারণ বাবার সঙ্গে আমার কোনো স্মৃতি নাই। বুঝ হওয়ার পর থেকে বাবা জেলে। যেন বেঁচে থেকেও না থাকার মতো।'
উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে সে বলে, 'আজ আমি অনেক খুশি, কারণ আমার বাবা আজ মুক্তি পাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।'
বন্দি সাবেক বিডিআর সদস্যদের মুক্তির খবরে সকাল থেকে তাহসিনের মতো অন্যান্য জওয়ানদের স্বজনেরাও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ভিড় করেন। তাদের অধিংকাংশের হাতে ছিল ফুলের তোড়া।
পুরান ঢাকার হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দা রেহানা বেগম বলেন, 'আমার স্বামী বিডিআর সদস্য ছিলেন। তাকে দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়ভাবে কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল। আজ আমার স্বামীকে আমরা মুক্ত অবস্থায় ফিরে পাব। তাই সকাল থেকে সন্তানদের নিয়ে অপেক্ষা করছি।'
দুপুর ১টায় একে একে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন বিডিআর সদস্যরা।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর বিডিআর সদস্যদের কাছে স্বজনরা অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।
কারাবন্দি বিডিআর কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত প্ল্যাটফর্ম 'জাস্টিস ফর বিডিআর' বছরের পর বছর ধরে তাদের মুক্তির জন্য প্রচারণা চালিয়ে আসছিল।
এই প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র ছিলেন ২০১৮ সালে কারাগারে মারা যাওয়া নায়েক শামসুল আলমের ছেলে জুয়েল আজিজ।
জুয়েল টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় হচ্ছে। কিছু বিডিআর সদস্য আজ মুক্তি পেয়েছেন। এখনও অনেক বিডিআর সদস্য কারাগারে আছেন মিথ্যা মামলায়। অথচ তারা ঘটনার দিন ঢাকাতেই ছিলেন না।'
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'কারাফটকে দাঁড়িয়ে যখন দেখছিলাম, আঙ্কেলরা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলিঙ্গন করছেন, মনে হচ্ছিল বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমাকেও এভাবে জড়িয়ে ধরতেন।' কথাটা বলেই কান্নায় ভেড়ে পড়েন জুয়েল।
জামিনে মুক্তি পাওয়া ময়মনসিংহ ৪৫ ব্যাটালিয়নের সিপাহী মো. এনামুল বলেন, 'আমরা যারা নিরপরাধ ছিলাম, আমাদেরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাঠাইছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। আমাদের সবাইকে চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে। সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এ ঘটনায় যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের শাস্তি দিতে হবে।'
দীর্ঘ কারাভোগের পর মুক্তি পাওয়া ঢাকা সদর ব্যাটালিয়নের সিপাহী আবু হাসান বলেন, 'যখন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে, তখন আমার চাকরির বয়স ছয় মাস। পিলখানাতে পাঁচটি গেট আছে, সেই পাঁচটি গেটই আমি চিনতাম না। অথচ আমাকে করা হয়েছে আসামি। যেসব সিনিয়র স্যারদের আমরা পিতার সমতুল্য সম্মান করতাম, আজকে তাদের হত্যার দায়ে আমাদেরকে মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করতে হয়েছে ১৬টি বছর। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, আমরা যেন আমাদের হারানো সম্মান ফিরে পাই।'
সাবেক বিডিআর সদস্যদের মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে কারা অধিদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. জান্নাত-উল ফরহাদ টিবিএসকে বলেন, '২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ-সংক্রান্ত বিস্ফোরক মামলায় অভিযুক্ত মোট ১৬৮ জনকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের বিভিন্ন ইউনিট থেকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।'
বিডিআর বিদ্রোহ ও পরিণতি
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়।
পরে বাহিনীর নাম বদলে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে কিছু বিডিআর সদস্য মুক্তি পেলেও বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে যায় ৪৬৮ সদস্যের।
হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি ছাড়াও ১৬০ জনের যাবজ্জীবন এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া খালাস পান ২৭৮ জন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনে পর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুনঃতদন্তের দাবি জোরালো হয়।
গত ১৯ ডিসেম্বর অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা। পর্বতীতে এই হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তের জন্য গত ২৪ ডিসেম্বর আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে কমিশন গঠন করে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছে সরকার।
এদিকে কারাবন্দি বিডিআর সদস্যদের মুক্তিসহ তিন দফা দাবিতে অবরোধ, মানববন্ধন, অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য ও জেলবন্দি সদস্যদের পরিবার।
আন্দোলনের মধ্যে ২০ জানুয়ারি বিস্ফোরক মামলায় জামিন পান দুই শতাধিক বিডিআর সদস্য।
তাহসিন আক্তারের গল্প
মুঠোফোনে টিবিএসের কথা হয় তাহসিনের বাবা দুলাল মিয়ার সঙ্গে। তখন তিনি গাড়িতে ছিলেন, গ্রামের বাড়ি হোমনা যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'শেখ হাসিনা নিজের অপরাধ ঢাকতে আমাদের ফাঁসিয়েছেন। আমাদের জীবনের সুন্দর সময়গুলো কারাগারে কাটাতে হয়েছে। অবশেষে বর্তমান সরকার সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করেছে বলে মেয়েদের কাছে ফিরে আসতে পেরেছি। '
শেষবার বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, 'সর্বশেষ যখন বাড়ি থেকে আসি, তখন বাবা-মা দুজনই ছিলেন। ১৬ বছর পর বাড়ি ফিরছি, কিন্তু তারা কেউ বেঁচে নাই।'
চাকরি চলে যাওয়ায় আর্থিক সচ্ছলতাও হারায় দুলাল মিয়ার পরিবার। দুলালের অবর্তমানে তার বড় ভাই সংসারের দেখভাল করতেন।
'এখন তো আমি ছাড়া পেয়েছি। সরকারের কাছে দাবি, আমরা নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছি, তাই আমাদের চাকরি যেন তারা ফিরিয়ে দেন,' বলেন দুলাল।