কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন ১২৭ বিডিআর সদস্য
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা বিস্ফোরক মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভের পর গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১২৭ জন বিডিআর সদস্য মুক্তি পেয়েছেন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারগারের বিভিন্ন ইউনিটে থাকা ১২৭ জন বন্দী আজ সকাল থেকে পর্যায়ক্রমে মুক্তি পান। তাদের অভ্যর্থনা জানাতে কারাফটকে ভিড় করেছিলেন স্বজনেরা।
বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১২৭ জন বন্দির মধ্যে ১৩ জন মুক্তি পান।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তিনি বলেন, 'বৃহস্পতিবার ভোরে ১৩ বিডিআর সদস্যদের মুক্তির কাগজপত্র কারাগারে আসে। এগুলো যাচাই-বাছাই শেষে অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকায় তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়।'
একই দিনে বেলা সাড়ে ১১ টার সময় কারাগার-১ থেকে ২৫ বিডিআর সদস্য মুক্তি পান।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন কাশিমপুর কারাগার-১ এর জেল সুপার মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'এই কারাগারে ৮৪ জন বিডিআর সদস্য বন্দী রয়েছেন। তাদের মধ্যে জামিন পাওয়া ২৫ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের মুক্তির কাগজপত্র কারাগারে আসলে তা যাচাই-বাছাই শেষে অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকায় তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়।'
সর্বশেষ দুপুর দেড়টায় কারাগার -২ থেকে জামিন পাওয়া ৭৯ বিডিআর সদস্য কারামুক্ত হয়েছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন কাশিমপুর কারাগার-২ এর সিনিয়র জেল সুপার মো. আল মামুন।
তিনি বলেন, 'এই কারাগারে ৩৭৮ জন বিডিআর সদস্য বন্দি রয়েছেন। এসব বন্দির মধ্যে ৭৯ জন জামিন পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকায় মুক্তি দেওয়া হয়েছে।'
এদিকে, ১২৭ জন বিডিআর সদস্যের মুক্তির খবরে সকাল থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। প্রথমে সকাল সাড়ে ১০টার সময় হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৩ জন বিডিআর সদস্য বের হন। এর পর পর্যায়ক্রমে কারাগার-১ ও কারাগার-২ থেকে ১১৪ জন বিডিআর সদস্য বের হন।
এ সময় জামিনে মুক্তি পাওয়া বিডিআর সদস্যরা পরিবারের সদস্যদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরিবার ও বিডিআর সদস্যদের আহাজারিতে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
জামিনে মুক্তি পাওয়া ময়মনসিংহ ৪৫ ব্যাটেলিয়ন এর সিপাহী মো. এনামুল বলেন, 'আমরা যারা নিরপরাধ ছিলাম, আমাদেরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল খাটাইছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার।'
এ সময় তিনি দাবি করেন, 'তিনিসহ সবাইকে পুনরায় চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে। সব ধরনের সুযোগ-সবিধা দিতে হবে। এঘটনায় যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের শাস্তি দিতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদেরকে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি, শুধু বলা হয়েছে সাক্ষী দিতে হবে। কার নামে সাক্ষী দিতে হবে আমরা কিছুই জানি না। সাক্ষী দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমাদেরকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠায় খুনি হাসিনা সরকার।'
দীর্ঘ কারা ভোগের পর মুক্তি পাওয়া ঢাকা সদর ব্যাটিলয়নের সিপাহী আবু হাসান বলেন, 'যখন বিডিআর বিদ্রোহ হয় তখন আমার চাকরির বয়স ছয়মাস। পিলখানাতে পাঁচটি গেট আছে, সেই পাঁচটি গেটই আমি চিনতাম না। অথচ আমাকে করা হয়েছে আসামি। যেসব সিনিয়র স্যারদের আমরা পিতা সমতুল্য সম্মান করতাম, তাদের হত্যার দায়ে আমাদেরকে মিথ্যা মামলায় কারাভোগ করতে হয়েছে ১৬টি বছর।'
তিনি বলেন, 'সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমরা যেন আমাদের হারানো সম্মান ফিরে পাই।'
সকালে কাশিমপুর কারা ফটকে বাবার মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছিলেন ঢাকা সদর ব্যাটলিয়ন সিপাহী জামাল উদ্দিন খানের মেয়ে জুয়েনা জামাল ঐশী।
অন্য বন্দীদের মুক্তি পেতে দেখে তিনি অধীর আগ্রহে বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছিলেন। এই বুঝি তার বাবা এল।
এমন পরিস্থিতিতে তিনি বলেন, 'আমার বাবাকে আমি চিনি না। বড় হয়ে শুনেছি আমার বয়স যখন ১ বছর তখন আমার বাবাকে বিডিআর হত্যা মামালায় আসামি করে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর বাবার মুখ দেখতে পারব। এই অনুভূতির কথা বলে শেষ করা যাবে না। কোনদিন বাবার আদর পাইনি। আজ মন ভরে বাবাকে দেখব।'
জুয়েনা জামাল ঐশী যখন এসব কথা বলছিলেন, তার চোখ দিয়ে তখন অঝোরে অশ্রু ঝরছিল।
গত ২০ জানুয়ারি রোববার বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা বিস্ফোরক মামলায় জামিন পেয়েছেন হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্ত ও যাদের বিরুদ্ধে কোনো আপিল হয়নি এমন ২ শতাধিক আসামি।
কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মো. ইব্রাহিম মিয়ার অস্থায়ী আদালত তাদের এই জামিন দেন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে ৪৬৮ জনের মুক্তি আটকে আছে।
হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। যেখানে ১৫২ জনের ফাঁসি ছাড়াও ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া, খালাস পান ২৭৮ জন।