নিয়মের জটিলতায় ক্ষতিপূরণ পেতে দেরি আহত ও নিহতদের পরিবারের, সদুত্তর নেই জুলাই ফাউন্ডেশনের
জুলাই গণঅভুত্থানে আহত ও নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে বিলম্ব হওয়ায় সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী জানিয়েছেন, এব্যাপারে ফাউন্ডেশনের কাছে জবাব চাইলেও কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
একইসাথে বিলম্ব ও দীর্ঘসূত্রিতা, স্পষ্টতার অভাব, সহানুভূতি এবং পেশাদারিত্বপূর্ণ মনোভাবের অভাব, এবং চিকিৎসাসেবা সম্পর্কিত অসন্তুষ্টি নিয়ে লিখিতভাবে উদ্বেগ জানিয়েছে নাগরিক কমিটি।
গত ১৯ জুলাই রায়েরবাগে এক হাত দূর থেকে ছোঁড়া গুলিতে আহত হন তামজিদ হাসান। হাত ও বুকে পিলেট বিদ্ধ হয় তার। দুটি অপারেশন করিয়ে প্রায় ৫ লাখ টাকা খরচ করলেও শেষ করতে পারেননি চিকিৎসা, করাতে হবে আরও একটি অপারেশন।
তামজিদ জানান, তিন মাস হতে চললেও কোনো সাহায্য বা উত্তর পাননি। কুমিল্লার আত্মীয়স্বজনদের সাহায্যে কোনোমতে দিন চলছে। তিনি বলেন, ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট বাংলায় না হওয়ায় আমাদের আরও বেশি জটিলতা পোহাতে হচ্ছে। আমার মতো অনেক আহতই বুঝতে পারছেন না কীভাবে ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন সংক্রান্ত আপডেট জানতে হয়।
১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হওয়া ইয়াসিন মিয়ার শরীরে এখন পর্যন্ত ১৩টি অপারেশন করতে হয়েছে। চিকিৎসায় ৭ লাখ টাকা খরচ হলেও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ইয়াসিন মিয়া প্রাথমিকভাবে ১ লাখ টাকা পেয়েছেন।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যোগাযোগে সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আহতদের আর্থিক সহায়তায় বিলম্বের প্রধান কারণ। আমাকেই আর্থিক সহায়তা পাওয়ার জন্য অন্ততপক্ষে ৮টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে। এধরনের বিড়ম্বনা পোহাতে এবং বোঝা শুনার অভাবে অনেকেই ফাউন্ডেশনের নিয়ম অনুসরণ করে আর্থিক সহায়তা পেতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এবিষয়ে নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী সংগঠনটির এক প্রতিনিধি সভায় বলেন, 'আন্দোলনের অনেক শহীদ সুচিকিৎসার অভাবে শহীদ হয়েছেন। তাদেরকে বিদেশেও পাঠানো হয়নি। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনেরও কোনো কার্যকরী উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। আমরা ফাউন্ডেশনের কাছে চিঠি পাঠিয়ে একটি জবাবও চেয়েছিলাম'।
তিনি বলেন, 'এখনও যে-সব আহত শহীদ হওয়ার পথে এগোচ্ছে তাদের জন্য আপনারা কী করছেন। সেখানে আমাদের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও একজন শহীদের ভাই মুগ্ধ আছেন, তাদেরকে আমরা বারবার জিজ্ঞেস করেছি, কিন্তু কোনো সদুত্তর দিতে পারছেনা। তাদের কাছে আমরা জবাব চাইব এবং চিকিৎসা প্রদানে তাদেরকে বাধ্য করব, আমরা সেই প্রসেসেই আগাচ্ছি'।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারকে স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক সহায়তা এবং দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দেওয়ার বিষয়কে সামনে রেখে ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর 'জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের' কার্যকরী পরিষদের অনুমোদন দেয় সমাজসেবা অধিদপ্তর।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি ও শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধকে সাধারণ সম্পাদক করে সংস্থাটির সাত সদস্যের কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়।
পরে ১৭ সেপ্টেম্বর প্রাথমিকভাবে প্রত্যেক শহীদের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা এবং আহত প্রত্যেক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা করা হয়।
পরবর্তী সময়ে ২১ অক্টোবর ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। আর মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান।
তবে ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনার মুখে গত বুধবার (২২ জানুয়ারি) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এক পোস্ট দিয়ে, জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আর জড়িত না থাকার কথা জানান সারজিস।
জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আহতদের চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তা পেতে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশনের জটিল প্রক্রিয়ার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাব-সেলের সদস্য ইয়াসিন মিয়া জানান, সহায়তার জন্য ফাউন্ডেশনের নির্ধারিত ফরমে বিসিএস ডাক্তারের সিল অথবা যে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেওয়া হয়েছে, সেই হাসপাতালের ডিরেক্টরের সিল নিতে হয়।
তিনি বলেন, 'আন্দোলনের সময় আহত হওয়ার টিকেট বা ছাড়পত্রের উপর সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের এমবিবিএস ডাক্তারের সিল দরকার। রোগীর নিজস্ব এনআইডি ব্যবহার করে বিকাশ অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। বিকাশ অ্যাকাউন্ট না থাকলে পিতা-মাতা বা পরিবারের অন্য সদস্যের বিকাশ নম্বর দিলেও সেই নম্বরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এনআইডি এবং এমবিবিএস ডাক্তারের সিল নিতে হয়।'
ইয়াসিন মিয়া আরও বলেন, 'আহত হওয়ার একটি ছবি বা ক্ষতস্থানের ছবি জমা দিতে হয়। এই ডকুমেন্টগুলো সরকারি হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগে এন্ট্রি করাতে হয়। এরপর রোগীর স্থায়ী ঠিকানায় গিয়ে সিভিল সার্জন বা ডিসি অফিস থেকে এসব ডকুমেন্ট ভেরিফাইড করাতে হয়। সবশেষে, ডকুমেন্টগুলো জুলাই ফাউন্ডেশনের ডাক, ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে বা সরাসরি গিয়ে জমা দিতে হয়।'
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণ অভ্যুত্থান বিষয়ক বিশেষ সেলের সম্পাদক হাসান এনাম বলেন, যোগাযোগের সমন্বয়হীনতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে ওয়ান স্টেপ সল্যুশন প্রয়োজন ছিল। আহত ও নিহতদের জন্য একটি ইউনিক কেস আইডি থাকলে তাদের পরিবারকে হয়রানির শিকার হতে হতো না। আহত ও নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা গ্যাজেটেড হলে এই সমস্যা দেখা দিত না।
তিনি আরও বলেন, 'নিহতদের মধ্যে ৮৩৪ জনের নাম গ্যাজেটেড হলেও সবাই সহযোগিতা পাননি। এখনো অনেক নিহতের নাম তালিকায় নেই। এজন্য আহতদের চিকিৎসার পাশাপাশি তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।'
এদিকে, গত ১৭ জানুয়ারি জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে জানানো হয়, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের সহায়তায় মোট ৫৩ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এতে ২৭২০টি পরিবার সহায়তা পেয়েছে।
এর মধ্যে ৩৩ দশমিক ১৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে ৬৬৩টি শহীদ পরিবারের মাঝে এবং ২০ দশমিক ৪৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে ২০৫৭ জন আহত ব্যক্তিকে। তবে, আহত ব্যক্তির তালিকা এখনো প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। বর্তমানে তালিকায় আহতদের সংখ্যা ১১ হাজারের বেশি এবং নিহতের সংখ্যা ৮৩৪ জন।
বুধবার নাগরিক কমিটির দপ্তর সেল থেকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে ৫টি উদ্বেগের কথা জানানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, 'ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদানে বিলম্ব ও দীর্ঘসূত্রতা, আবেদনপত্রের ফলাফল সম্পর্কে স্পষ্টতার অভাব, ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে সহানুভূতি ও পেশাদারিত্বের ঘাটতি, এবং চিকিৎসা সেবা নিয়ে অসন্তুষ্টি' রয়েছে।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বেশ কিছু আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা আবেদনপত্র জমা দিয়ে ফাউন্ডেশন থেকে টোকেন নম্বর পেয়েছেন। তবে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও তারা কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি। কিছু ক্ষেত্রে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই আবেদনকারীদের জানানো হয়েছে যে, তাদের আবেদন কার্যকর করা যাচ্ছে না এবং পুনরায় আবেদন করতে হবে। এই বিলম্ব আহত ও শহীদ পরিবারের জন্য হয়রানি এবং অনিশ্চয়তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও, অভ্যুত্থানে আহত এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাথে ফাউন্ডেশনের আচরণ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নাগরিক কমিটি। অনেকে তাদেরকে (নাগরিক কমিটি) জানিয়েছেন, ফাউন্ডেশনের হেল্পলাইনে ফোন করে কথা বলার সময়ে বা অফিসে এসে সরাসরি যোগাযোগের সময় অশোভন এবং অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ পেয়েছেন।
নাগরিক কমিটির চিঠিতে বলা হয়েছে, আহতদের অনেকেই এমআইএস ভেরিফিকেশন তালিকায় নেই, যার ফলে তাদের সহায়তা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে বিভ্রান্তি, দীর্ঘসূত্রতা, এবং উদ্বেগ সৃষ্টি হচ্ছে। এই বৈষম্য কী কারণে ঘটছে এবং কীভাবে এগুলো সমাধান করা হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রার্থনা করছি।
এছাড়া কিছু শহীদ পরিবার এখনও কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি, কারণ পরিবারের কোন সদস্য কী পরিমাণে আর্থিক সহায়তা পাবেন তা নিয়ে আইনি জটিলতা আছে। এই ধরনের সমস্যা দ্রুত সমাধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে পরিবারগুলো দীর্ঘ সময় অনিশ্চয়তার মধ্যে না থাকে। এসব বিষয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের সাথে বসতে চায় বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছে নাগরিক কমিটি।
এ বিষয়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। একইভাবে ফাউন্ডেশনের সদস্য ও সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এম মুরশীদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
তবে আর্থিক সহায়তায় বিলম্বের কারণ নিয়ে ফাউন্ডেশনের প্রধান গ্রাহক সেবা কর্মকর্তা সায়েদুর রহমান শাহেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এখানে মূল সমস্যা ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ায়। অনেকের নাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আহতদের তালিকায় না থাকায় আমরা সহায়তা করতে পারছি না। কারণ, অনেকেই মেডিকেল ডকুমেন্টসের মাধ্যমে আন্দোলনে আহত হওয়ার সঠিক প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রতারণার ঘটনা চিহ্নিত করেছি এবং তিনজনের কাছ থেকে অর্থ ফেরত নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, এটি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নয়, প্রকৃত ভুক্তভোগীদের চিহ্নিত করতেই সময় লাগছে। এমনও দেখা গেছে, জমিজমা নিয়ে বিবাদের জেরে আহত কেউ সব নথি জমা দিয়ে সহায়তা নিয়েছেন। পরবর্তীতে ভেরিফিকেশনে প্রমাণিত হলে অর্থ ফেরত নেওয়া হয়েছে।
গ্যাজেটেড তালিকায় থাকা নিহত পরিবারের আর্থিক সহায়তায় বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, শহীদ পরিবারের নমিনি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ভেরিফিকেশন করতে সময় লাগছে।
ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট বাংলায় না হওয়া প্রসঙ্গে সায়েদুর রহমান শাহেদ বলেন, ওয়েবসাইট মূলত বিদেশি ডোনারদের জন্য ইংরেজিতে করা হয়েছে। তবে বাংলায় থাকলে ভালো হতো। অনেক ভুক্তভোগী এ বিষয়ে আমাদের জানিয়েছেন। এটি যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে।