পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে হতাশ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/09/police_rab_bgb_0.jpeg)
পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নিয়ে কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবে হতাশ মধ্যমসারীর মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, কমিশনের প্রস্তাবগুলোতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অবৈধ আদেশ অমান্য করার বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়েছে।
এছাড়া, সৈনিকদের তুলনায় তাদের পদোন্নতি ধীরগতির হলেও এ বিষয়ে কোনো সুপারিশ করেনি সংস্কার কমিশন।
এই কর্মকর্তারা বলছেন, বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন (এসিআর) ব্যবস্থার কারণে তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েন। মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে সুপারভাইজিং কর্মকর্তারা প্রভাব বিস্তার করেন– যা অনেক সময় তদন্তের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে এসব ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদালতের কাছে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না, যা সংস্কারের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ।
পুলিশর সাবেক কর্মকর্তারাও বলছেন, পুলিশের নিয়োগের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা দরকার। তিন স্তর থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া দুই স্তরে আনা গেলে পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতা আর থাকবে না।
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মরত উপ-পরিদর্শক মর্যাদার এক পুলিশ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "আমাদের সিনিয়র অফিসাররা মাঝে মাঝে এমন আদেশ করেন, যেগুলো 'পলিটিক্যালি মোটিভেটেড'। কিন্তু এসিআর (বার্ষিক গোপন প্রতিবেদন) নেতিবাচক হবে এমন ভয় থেকে আমরা ওই আদেশ বাস্তবায়ন করি। কেননা আমাদের পদোন্নোতি খুবই কম হয়। তারমধ্যে এসিআর নেতিবাচক হলে সেটিও হবে না। কিন্তু এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের কোনো দিক নির্দেশনা নেই।"
"আমাদের এসিআর ঊধ্বর্তন পুলিশ কর্মকর্তারা করলে সমস্যা নেই, কিন্তু অধস্তন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে যদি তার সিনিয়র অফিসারের বিষয়ে প্রতিবেদন নেওয়া হয়– তবে পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে," যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে (সিএমপি) কর্মরত এক পুলিশ পরিদর্শক টিবিএসকে জানান, "অধিকাংশ মামলার তদন্ত করেন সাব-ইন্সেপেক্টর ও ইন্সেপেক্টররা। কিন্তু সুপারভাইজিংয়ের দায়িত্বে থাকেন সিনিয়র অফিশিয়ালরা। তারা প্রায়শই মামলার তদন্ত প্রভাবিত করেন।"
"কিন্তু তদন্তের বিষয়ে আদালতের কাছে গিয়ে আমাদের জবাবদিহিতা করতে হয়। যেই সিনিয়র অফিশিয়াল তদন্তকে প্রভাবিত করলেন, তাকে কিন্তু কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না," যোগ করেন তিনি।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, "আমরা এ বিষয়েগুলো নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা আশা করেছিলাম। কিন্তু কমিশন থেকে কোনো প্রস্তাবনা না থাকায় আমরা হতাশ হয়েছি।"
সাবেক আমলা সফর রাজ হোসেনের সভাপতিত্বে পুলিশ সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের সুপারিশ ও প্রস্তাব-সম্বলিত প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনে পুলিশ স্বাধীন কমিশন গঠন, নারী সদস্য নিয়োগ, বল প্রয়োগসহ বেশকিছু বিষয়কে ইতিবাচকভাবে দেখা হলেও সিনিয়রদের অবৈধ আদেশ অমান্য ও সৈনিকদের তুলনায় কম পদোন্নোতির বিষয়ে কোনো সুপারিশ নেই।
এ বিষয়ে জানতে কমিশন প্রধান সফর রাজ হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
পদোন্নতিতে ধীরগতি
অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) কর্মরত এক পুলিশ পরিদর্শক টিবিএসকে জানান, তিনি ১৫-১৬ বছর ধরে পুলিশে কর্মরত রয়েছেন। এরমধ্যে একটি মাত্র পদোন্নোতি পেয়েছে তিনি। তার চাকরির বয়স আরও ১৫ বছর আছে। তবে এই সময়ের মধ্যে আরেকটি পদোন্নোতি পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
"উপ-পরিদর্শকদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি মাত্র পদোন্নোতি নিয়ে কর্মজীবন শেষ করতে হয়। একজন সাব-ইন্সেপেক্টর ১০-১২ বছর পর ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নোতি পান। কিন্তু ইন্সপেক্টর থেকে অল্প সংখ্যাক পুলিশ সদস্যই এসএসপি (সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ) হতে পারেন। আমরা চাকরি বয়স এখনও ১৪-১৫ বছর বাকি। তবে এই সময়ে পদোন্নোতি পাওয়ার সম্ভাবনা কম।"
"আমাদের তুলনায় কনস্টেবল পদে যারা যোগদান করেন, তারা বেশি পদোন্নোতি পান," যোগ করেন তিনি।
দ্বি-স্তর নিয়োগ ব্যবস্থা
এদিকে, পুলিশ সংস্কার নিয়ে বিএনপির গঠিত কমিটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি (৫ ডিসেম্বর, ২০২৪) সংস্কার কমিশনের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। মেজর (অব.) হাফিজের নেতৃত্বাধীন এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. আশরাফুল হুদা।
বিএনপির পক্ষ থেকে বিদ্যমান পুলিশ বাহিনীর ব্যবস্থায় তিন স্তরের নিয়োগ কাঠামো কমিয়ে দুই স্তরে আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সাব-ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতা অনেকটাই দূর হবে।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন, "বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। তবে অধস্তন কর্মকর্তাদের দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন লেখার কোনো দরকার নেই। কারণ আইজিপি ছাড়া অন্য সকলের এসিআর তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই তৈরি করেন।"
পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদও পুলিশের তিন স্তরের নিয়োগ কাঠামো কমিয়ে দুই স্তরে আনার প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে তিনি মনে করেন, "মামলার তদন্তে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রভাব খাটানোর প্রবণতা খুবই সীমিত। একে গণহারে বলা ঠিক হবে না।"
তিনি বলেন, "সংস্কার কমিশন অল্প সময়ে একটি সুপারিশ তৈরি করেছে। এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সরকার বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। তখন হয়তো এ ধরনের প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।"
পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, "পুলিশকে সত্যিকার অর্থে সংস্কার করতে হলে প্রথমে তাদেরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এটাই সবচেয়ে জরুরি।"