বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম: ‘লাইট জ্বলে না’ ১৫ বছর, তবু বিল ৩ কোটি টাকা
প্রায় ১৫ বছর ধরে বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের রাতের খেলায় ফ্লাডলাইটগুলোতে আলো জ্বলছে না। এই সময়ের মধ্যে ডে-নাইট কোনো খেলাও হয়নি। কোনো প্রয়োজনেও এই লাইটগুলো জ্বালানো হয়নি। অথচ বিদ্যুৎ খাতে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষকে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই স্টেডিয়ামের আন্তর্জাতিক কোনো খেলা না থাকলেও ১৫ বছরে অন্তত তিন কোটি টাকা গুনতে হয়েছে। এই বিল পরিশোধ করতে হয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদকে। কোনো কোনো মাসে জরিমানাসহ প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা বিলও দিতে হয়েছে। বিষয়টি বগুড়ার এই স্টেডিয়ামের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন।
বগুড়ার স্টেডিয়ামটিতে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানী লিমিটেড থেকে সংযোগ নেওয়া হয়েছে। শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বিশেষ লাইন নেওয়ার কারণে এখানে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন বিল পরিশোধ করতে হয় অন্তত ৬০ হাজার টাকা। গত কয়েক বছরে স্টেডিয়ামে গড়ে বিদ্যুৎ বিল আসছে ১ লাখ ১০ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। যদিও দ্য বিজনেস স্ট্যার্ন্ডাডের কাছে ২০২০- ২০২১ সালের ১৩ মাসের গড় বিল পাওয়া গেছে এক লাখ ৬৯ হাজার। অনেক সময় কয়েক মাসের জরিমানাসহ সাড়ে ৪ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। তবে ১৩ মাসের গড় বিলের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, গত ১৫ বছরে শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে ৩ কোটি টাকার ওপর পরিশোধ করতে হয়েছে।
স্টেডিয়াম সূত্রে জানা যায়, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকায় বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে একটি আন্তর্জাতিক ভেন্যুতে (ফ্লাড-লাইটসহ) উন্নীত করা হয়। এই মাঠে আগে থেকেই ভালো মানের পাঁচটি উইকেট (পিচ) রয়েছে। ২০০৬ সালের ৩০ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে ঘোষণা করে। একই বছরে স্টেডিয়ামটি আন্তর্জাতিক টেস্ট ভেন্যুর স্বীকৃতিও পায়।
কিন্তু অজানা কারণে ২০০৬ সালের পর থেকে এ মাঠে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে দর্শকদের ভাগ্যে কোনো খেলা উপভোগ জোটেনি। তবে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় লিগ, স্থানীয় প্রিমিয়ার ডিভিশন, প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ ও করপোরেট লীগ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব ম্যাচের সবগুলোই দিনে অনুষ্ঠিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিনে খেলার জন্য এই মাঠের ফ্লাড লাইট জ্বালোনোর কোনো প্রয়োজন নেই। স্টেডিয়ামে চার টাওয়ারে ১০০টি করে মোট ৪০০ ফ্লাড-লাইট রয়েছে। এই লাইটগুলো ৮ লাখ ওয়াট বিদ্যুতের আলো সরবরাহ করতে পারে। আন্তর্জাতিক খেলা বন্ধের পরে ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে একবার ফ্লাডলাইটগুলো জ্বালানো হয়েছিল। তবে এরপর সেগুলো আর জ্বলেনি। এর মধ্যে কোনো লাইট নষ্ট রয়েছে কিনা তাও বলতে পারেনি স্টেডিয়ামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা।
স্টেডিয়ামের প্রশাসনিকসহ সব ভবনে মোট এয়ারকন্ডিশনিং মেশিন (এসি) রয়েছে ৩২নটি। কিন্তু এখন এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২টির ব্যবহার হয়। তাও গ্রীষ্মকালে। সামগ্রিকভাবে পুরো স্টেডিয়ামে চারটি মিটার ব্যবহার করা হয়। স্টেডিয়ামে কোনো আবাসিক কর্মকর্তা বা কর্মচারী নেই। অথচ প্রতি মাসে বিল আসছে লাখ টাকার উপরে।
পাশাপাশি স্টেডিয়ামের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও প্রতি মাসে সরকার ব্যয় করছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। অথচ বলতে গেলে বর্তমানে এই স্টেডিয়ামের কোনো 'আউটপুট' নেই। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে স্টেডিয়ামের বিভিন্ন অবকাঠামোও।
স্টেডিয়ামের ভেন্যু ম্যানেজার জামিলুর রহমান জামিলও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইট সংযোগ থাকার জন্য বিলের পরিমাণ বেশি হয়। আর বিদ্যুৎ বিভাগ এখন প্রতি মাসে গড় বিল করছে। তবে অতিরিক্ত বিলের বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা ইনডোর বক্স স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। এটি নিয়ে বিসিবি বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে কথা বলছে। এতে অতিরিক্ত বিল বন্ধ হবে বলে আশা করছেন ভেন্যু ম্যানেজার।
শুধু বিলের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ হলেও বগুড়ার ক্রিকেটপ্রেমীদের আফসোস ভিন্ন দিকে। খুব ভালো মানের উইকেট (পিচ) হওয়ার পরও এ মাঠ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের খেলা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। কিন্তু এ জেলা থেকেই মুশফিকুর রহিম, শুভাসদের মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটারের জন্ম হয়েছে। শুধু তাই নয়- হৃদয়, তামিমদের মতো অনেক নতুন মুখও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গনে।
বিভিন্ন সময়ে ক্রিকেটের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক খেলোয়াড় ও বোদ্ধা শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের উইকেটকে 'দেশসেরা' বলে মন্তব্য করেছেন। এদের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) রেফারি ক্লাইভ লয়েড, পাকিস্তানি খেলোয়ার ওয়াসিম আকরাম, শ্রীলংকার জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন মাহেলা জয়াবর্ধনে, টিএমন দিলশান, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটার তাতেন্ডা তাইবুর মতো খেলোয়াড় রয়েছেন। ক্রিকেট বোদ্ধাদের দাবি, এই উইকেটে বাউন্স ভালো পাওয়া যায়।
অথচ এই মাঠে বল গড়ায় না এখন। আন্তর্জাতিক ভেন্যু থেকে বঞ্চিত থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বলেন, শহীদ চান্দু স্টেডিয়াম খুব সুন্দর একটা আন্তর্জাতিক ভেন্যু। বিশ্বের অনেক নামিদামি খেলোয়াড় এখানে খেলেছেন। আরও অনেক স্টেডিয়াম এখন হয়েছে। কিন্তু এই স্টেডিয়ামের বিকল্প নেই। সুতরাং এখানে লাখ লাখ কেন কোটি টাকা খরচ করে হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা করতে হবে।
স্টেডিয়ামের গুরুত্ব প্রসঙ্গে শহিদুল ইসলাম বলেন, শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে খেলা হলে শুধু বগুড়াবাসী নয়, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে দর্শকরা আসবে। এই মাঠই উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতির ক্ষেত্র হয়ে উঠবে।
জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক বলেন, আন্তর্জাতিক ভেন্যু হিসেবে চালু করার জন্য কয়েক দফায় চিঠি চালাচালি করা হয়েছে। স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্যও কথা বলা হয়েছে। তবে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। প্রতিমাসে এই স্টেডিয়ামে লাখ টাকার উপরে বিদ্যুৎ বিল দেওয়া হয়। এ বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা হয়েছে। আমরা আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি একটি সমাধানের রাস্তা তৈরি হবে।