স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সজট দূর করতে হিমশিম খাচ্ছে বিআরটিএ
চলতি বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি আটকে থাকা স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স ফের বিতরণ করা শুরু করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। কিন্তু কার্ডের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় আটকে থাকা কার্ড ঠিকমতো দিতে পারছে না।
স্মার্ট কার্ড হলো ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভৌত প্রমাণ। চালকের ব্যাপারে তথ্য সংরক্ষণের জন্য একে ডেটা চিপগুলোর সঙ্গে এমবেড করা হয়।
বিআরটিএর তথ্যানুসারে, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ এখন প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার কার্ড ইস্যু করছে। অক্টোবর পর্যন্ত আটকে থাকা লাইসেন্সের সংখ্যা ছিল ১২ লাখ ৪৫ হাজার। অর্থাৎ এই হারে বিতরণ চলতে থাকলে আটকে থাকা সমস্ত কার্ড বিতরণ করতে আরও প্রায় দুই বছর লেগে যাবে। অথচ অনেকেই এক-দুই বছর আগে লাইসেন্স করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে রেখেছেন বিআরটিএতে।
বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) সিতাংশু শেখর বিশ্বাস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বর্তমান গতিতে লাইসেন্স বিতরণ করে লাইসেন্সজট দূর করা সম্ভব নয়।
তিনি জানান, প্রতিদিনের কার্ড বিতরণ আড়াই হাজার থেকে ১৫ হাজারে উন্নীত করার চেষ্টা করছেন তারা। 'এ উদ্দেশ্যে আমরা এখন আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছি।'
লাইসেন্সজটের প্রধান কারণ ছিল স্মার্ট কার্ডের স্বল্পতা। লাইসেন্স তৈরির জন্য টাইগার আইটির সঙ্গে চুক্তি করেছিল বিআরটিএ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত হয়। ফলে সংকট দেখা দেয় কার্ড সরবরাহে।
এরপর বিআরটিএ নতুন কোম্পানির খোঁজ শুরু করে। কিন্তু তাতে লেগে যায় দেড় বছর। অবশেষে এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টারকে (এমএসপি)।
এমএসপি ২০১৯ সালে লাইসেন্স কার্ড প্রিন্ট করার কার্যাদেশ পেয়ে বাংলাদেশে একটি কারখানা স্থাপন করে।
চুক্তি অনুসারে, কোম্পানিটি পাঁচ বছরে ৪০ লাখ এবং ২০২১ সালের মধ্যে ৯ লাখ কার্ড সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি তা করতে পারেনি।
বিআরটিএর তথ্য অনুসারে, এমএসপি নয় মাসে মাত্র ১৩ হাজার কার্ড সরবরাহ করতে পেরেছে।
এ কারণে বাস্তবতা বুঝতে পেরে বিআরটিএ আটকে থাকা কার্ড ছাপানোর জন্য চলতি বছরের ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সঙ্গে একটি আলাদা চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এরপর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে টুলস ফ্যাক্টরি থেকে প্রিন্ট করা আটকে থাকা স্মার্ট লাইসেন্স বিতরণ শুরু করে কর্তৃপক্ষ। ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭২ হাজার কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে।
সিতাংশু শেখর জানিয়েছেন, কার্ড ছাপানোর গতি বাড়াতে সেনাবাহিনী-পরিচালিত কারখানাটি একটি উচ্চ-ক্ষমতার মেশিন নিয়ে আসছে, যা প্রতি ঘণ্টায় ৮০০ কার্ড ছাপাতে সক্ষম।
মেশিনটি জানুয়ারিতে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। আর ওই মেশিন চালু হয়ে গেলে তিন-চার মাসের মধ্যে আটকে থাকা লাইসেন্সের বিতরণ শেষ করতে পারবে বলে জানান সিতাংশু।
এদিকে কর্তৃপক্ষ চালকদের স্মার্ট লাইসেন্স না দিয়ে দুই-তিন মাসের জন্য প্রাপ্তিস্বীকারের রশিদ দিয়ে সাময়িক অনুমোদন দিচ্ছে। এই রশিদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বাড়িয়ে নিতে হয়। এর ফলে ভোগান্তিতে পড়ছেন সারা দেশের চালক ও বাইকাররা।
অবর্ণনীয় জনভোগান্তি
ড্রাইভিং ভিসা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া পরিকল্পনা ছিল জামাল হোসেনের। স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য প্রায় এক বছর অপেক্ষার পর গত সোমবার তিনি বহুল প্রতীক্ষিত লাইসেন্স হাতে পান। কিন্তু বিলম্বের কারণে বিদেশের চাকরি হারিয়েছেন।
ওই দিন মিরপুর বিআরটিএ অফিসে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, 'গত বছরের ডিসেম্বরে আমি সৌদি আরবে ড্রাইভিংয়ের কাজের জন্য ভিসা পেয়েছি। তখন আমি ঢাকায় একটা প্রাইভেট চাকরি করতাম।
'ওই চাকরি ছেড়ে আমি বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। কিন্তু শুধুমাত্র ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আমি যেতে পারিনি।'
জামাল জানান, সৌদিতে তার নিয়োগকর্তা বিআরটিএর দেওয়া প্রাপ্তিস্বীকার স্লিপটি গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। এখন এই মহামারিকালে তিনি বেকার হয়ে পড়েছেন।
আরেক ভুক্তভোগী বর্তমানে জাপান প্রবাসী রাশেদুল ইসলাম রাজ। ২০২০ সালের অক্টোবরে তিনি লাইসেন্সের জন্য বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তারপর থেকে বিআরটিএ কেবল তার সাময়িক অনুমতিপত্রের বৈধতাই বাড়াতে পেরেছে, আর কিছু করেনি।
রাজ বলেন, 'প্রতিদিন আমাকে যাতায়াতের জন্য কমপক্ষে ৫০০ জাপানি ইয়েন খরচ করতে হয়। আমার কাছে বাংলাদেশি থেকে লাইসেন্স থাকলে আমি জাপানে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারতাম। এতে নিজের গাড়ি রেখে কিছু টাকা বাঁচাতে পারতাম।'
লাইসেন্স না পাওয়ায় প্রবাসীদের পাশাপাশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে স্থানীয় চালকদেরও।
নাদিম হোসেন বলেন, 'আমি ২০১৯ সাল থেকে অপেক্ষা করছি, কিন্তু এখনও লাইসেন্স পাইনি। প্রাপ্তিস্বীকার স্লিপ দেওয়ার একটা অকেজো ব্যবস্থা আছে। পুলিশকে সব সময় এই স্লিপ দিয়ে বিশ্বাস করানো যায় না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি এখন ঢাকা থেকে অনেক দূরে মংলায় থাকি। বারবার স্লিপের মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব নয়। গত মাসে আমার স্লিপের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু এবার ঢাকায় যাব না।'
আরেক ভুক্তভোগী ওসমান গণি জানান, গত বছর তিনি ঢাকা বিআরটিএ অফিস থেকে লাইসেন্সের জন্য বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি কুমিল্লায় থাকেন। বারবার স্লিপের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ঢাকায় যাওয়া তার পক্ষে কঠিন।
ওসমানের মেয়াদ উত্তীর্ণ স্লিপ দেখে সম্প্রতি তাকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেছে ট্রাফিক পুলিশ।
বিআরটিএর পরিচালক ও মুখপাত্র শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, আটকে থাকা লাইসেন্স প্রিন্টের কাজ পুরোদমে চলছে।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে লাইসেন্সজট কাটানো যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'এখন আমরা নতুন আবেদনকারীদের সময়মতো স্মার্ট কার্ড প্রদান করছি।'