‘ছেলেকে জোর করে আর কাজে পাঠাব না’
পরিবারে চার সন্তানের মধ্যে তিনজনই প্রতিবন্ধী। ১২ বছরের সিহাব তাই পরিবারের একমাত্র 'কর্মক্ষম' সন্তান। আদমদীঘি উপজেলার কমলদুগাছী গ্রামের লুৎফর রহমান ও সোনাভানের ছোট ছেলে সে।
যে বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার কথা, বই নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা; সে বয়সে সিহাবকে প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করতে পাঠায় তার পরিবার। এই বয়সেই তিন ভাই-বোনসহ পুরো পরিবারের পেটে খাবার জোগানোর দায়ভার বর্তায় তার ছোট্ট কাঁধে।
আজ বুধবার বগুড়ার এক প্লাস্টিক কারখানায় আগুন লাগার পর থেকেই নিখোঁজ সিহাব।
আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন মা সোনাভান। কারাখানা অফিসের সামনে বসে চিৎকার করে কাঁদতে দেখা যায় তাকে। পুত্রশোকে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন এই মা।
কান্না জড়িত কণ্ঠে সোনাভান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কারখানায় ছেলে আমার কাজ করতে চাইত না। তারপরও তাকে জোর করে পাঠাতাম। অভাবের সংসার। আমি এবং আমার স্বামী দুজনই অসুস্থ।"
সোনাভান জানান, দু মাস ধরে এই কারখানায় সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে কাজ করছিল সিহাব। পুত্রের শোকে আহাজারি করতে করতে তিনি বলেন, "ছেলেকে জোর করে আর কাজে পাঠাতে হবে না। আল্লাহ জানে ছেলে এখন কোথায় আছে!"
নিখোঁজ সিহাব হোসেনের চাচি নাজমা জানান, সিহাবদের পরিবার খুবই দারিদ্র্য পীড়িত। দিনে একবেলা ভাতের জোগান পেতেই কষ্ট করতে হতো তাদের। যে কারণে অল্প বয়সেই জোর করে সিহাবকে কাজে পাঠায় তার মা।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার নওগাঁ-তিলোকপুর সড়কের পার্বতিপুর এলাকায় একটি প্লাস্টিকের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে নিহতদের মরদেহ এখনও সনাক্ত হয়নি।
এ ঘটনায় যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ চারজনের নাম সংগ্রহ করা হয়েছে।
নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছেন পালোয়ান পাড়ার বাসান এর ছেলে রিমন (১৫), ছাতনি গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে বেলাল হোসেন (৫৫), সান্দিরা গ্রামের নাসির উদ্দিনের ছেলে শাহজাহান (২৯), কমলদুগাছী গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে সিহাব হোসেন (১২)।
নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের কারখানার পাশে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ওয়ান-টাইম প্লেট সামগ্রী তৈরির এই কারখানায় প্রতিদিনের মতো আজও শ্রমিকরা সকাল থেকে কাজ করছিল।
কারখানায় দুই শিফটে মোট ৭০ জন শ্রমিক কাজ করে থাকেন, দিনে ৩৫ জন ও রাতে ৩৫ জন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, হঠাৎ করে কারখানার পশ্চিমাংশে থাকা প্লাস্টিকের কাঁচামাল রাখার জায়গা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এই আগুন মুহূর্তের মধ্যে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কারখানার এক পাশে আগুনের সূত্রপাত হলে শ্রমিকরা ভয়ে বেরিয়ে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিস ইউনিটে খবর দেওয়া হলে নওগাঁ, আত্রাই, রানীনগর, আদমদীঘি, দুপচাচিয়া থানার ১২টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা।
কারখানাটির মালিক সান্তাহার পৌরসভার মেয়র তোফাজ্জল হোসেন ভুট্ট টিবিএসকে বলেন, "সংবাদ পেয়ে কারখানায় আসি। কারখানায় ওয়ান টাইম প্লেট সামগ্রী তৈরি করা হতো। আগুনে কারখানার কাঁচামাল ভস্মীভূত হয়েছে। এতে প্রায় ৩০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।"
হতাহতের ব্যাপারে তিনি বলেন, "আগুন লাগার পরই ১৫-২০ জন শ্রমিক বেরিয়ে যায়। পাঁচ জন মারা গেছে। নিখোঁজদের বিষয়ে জানা সম্ভব হয়নি।"
ডিএনএ পরীক্ষার জন্য মরদেহ বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক জানান, এ ঘটনায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আদমদীঘি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও কলকারখানা পরিদর্শকসহ আরও কয়েকজন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।