উচ্চ ফলনশীল ফসলের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে তরুণ কৃষকদের
রাজশাহীর গোদাগারী উপজেলার কৃষক মোঃ তাসারুল ইসলাম গতানুগতিক ফসল চাষ করলেও খুব বেশি সচ্ছলতা ছিল না সংসারে। কিন্তু পরিবর্তন আসা শুরু করে যখন তিনি 'হাই ভ্যালু ক্রপ' বা উচ্চফলনশীল শস্য হিসেবে পেঁয়াজের বীজের চাষ শুরু করেন। আয় বৃদ্ধিতে উচ্চফলনশীল জাতের টমেটো ও বেগুণ চাষের পাশাপাশি ধীরে ধীরে গরু-ছাগলের খামারও গড়ে তোলেন এই কৃষক ।
৩৪ বছর বয়সী মোঃ তাসারুল ইসলাম বলেন, "একসময় শুধু ধানের চাষই করতাম। এ দিয়ে কোন রকমে সংসার চলতো। কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ট্রেনিং ও সহায়তা নিয়ে যখন পেঁয়াজ বীজের বাণিজ্যিক চাষ শুরু করি তখন থেকেই আয় বাড়তে থাকে। বর্তমানে কৃষি উৎপাদন ও খামার থেকে আমার বাৎসরিক আয় প্রায় ৫ লাখ টাকা।"
প্রডাক্ট ডাইভারসিফিকেশনের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল ও হাই ভ্যালু প্রডাক্টের চাষাবাদের মাধ্যমে তাসারুল ইসলামের মত আরও অনেকেরই আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে বাস্তবায়িত হয় এই 'সেকেন্ড ক্রপ ডাইভারসিফিকেশন প্রোজেক্ট (এসসিডিপি)'। গত নভেম্বর এডিবি এই প্রজেক্টের একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রডাক্ট ডাইভারসিফিকেশনের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল ও হাই ভ্যালু পণ্যের চাষের মাধ্যমে কৃষকের আয় বেড়েছে গড়ে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত। এর জন্য অবশ্য ভালো মানের বীজ ব্যবহার, ফসল কাটার পর ক্ষতির পরিমাণ কমানো, কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হয়েছে।
ফলাফলে দেখা গেছে, গ্রীষ্মকালীন উচ্চফলনশীল সবজি চাষ করে কৃষকরা সর্বোচ্চ ৮৬.৫ শতাংশ, বিভিন্ন মশলায় ২৬.৫ শতাংশ, ফলে ২৫.৭ শতাংশ ও অন্যান্য ফসলে ২০.৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি আয় করতে পেরেছেন।
প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে হাই ভ্যালু প্রডাক্টের চাষাবাদ করা। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রকল্প শেষে দেখা গেছে, ৯৪ হাজার হেক্টর জমিতে এর চাষাবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন কৃষক যখন ভালো ফসল ফলিয়েছেন, তখন তাকে দেখে অনেকেই উৎসাহী হয়ে ট্রেনিং নিয়েছেন এবং চাষাবাদ করেছেন। এ কারণে দ্রুত এর প্রসার হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ আসাদুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তরুন কৃষি উদ্যোক্তারা এখন সবচেয়ে বেশি হাই ভ্যালু প্রডাক্ট উৎপাদন করছেন। আবার অনেক কৃষক প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পেয়ে, বীজ ও ঋণের সুবিধা পেয়ে তাদের গতানুগতিক চাষাবাদ থেকে সরে আসছেন।"
তিনি বলেন, কৃষিতে এটি দারুনভাবে মূল্য সংযোজন করছে। আধুনিক কৃষির বাণিজ্যিক চাষাবাদ বাড়ানোই এখন আমাদের বড় লক্ষ্য।
এসসিডিপি প্রকল্পের আওতায় ৩ লাখ ২৫ হাজার কৃষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রকল্পের আওতায় তাদের মধ্যে আবার ঋণও বিতরন করেছে ব্র্যাক। তবে, এনজিও থেকে ঋণ নেওয়ায় কৃষকদেরকে উচ্চ সুদ গুনতে হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) মূল্যায়ন প্রতিবেদনে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পভূক্ত ঋণের সুদের হার কৃষকের কাছে বেশি। এছাড়া, উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে স্থানীয় কিছু সমস্যা ও ফসলের প্রকৃত দাম না পাওয়াও একটি ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
তবে আইএমইডি বলছে, প্রকল্পটি আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যে প্রভাব ফেলেছে তা একটি ভালো দিক। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রকল্প ভবিষ্যতেও নেয়া যেতে পারে। প্রকল্প এলাকায় দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত।
ফসল কাটা পরবর্তী ক্ষতি হ্রাস
পোস্ট হার্ভেস্ট লস ম্যানেজমেন্ট বা ফসল কাটার পরবর্তী ক্ষতি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফল ও শাকসবজিতে ১০ শতাংশ, আলুতে ২০ শতাংশ, মসলায় ১০ শতাংশ, ভুট্টায় ১৫ শতাংশ এবং ডালে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ফসলের ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে কৃষকদেরকে স্থায়ীভাবে পোস্ট হার্ভেস্ট লস কমিয়ে আনার জন্য কোন ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হয়নি, যা এই প্রকল্পের একটি নেতিবাচক দিক হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতানুগতিক ফসলের চাষ মৌসুম অনুযায়ী করা হলেও হাই ভ্যালু ক্রপ উৎপাদন করা যায় পুরো বছরজুড়েই। ফলে ভালোভাবে বাজারজাত করা গেলে, বছরের বেশিরভাগ সময়েই পাওয়া যায় বাড়তি দাম। তবে এই চাষাবাদের খরচ বেশি হওয়ায় প্রয়োজন হয় ঋণের। এই সুবিধাটুকু পাওয়া গেলে কৃষকরা হাই ভ্যালু ক্রপ উৎপাদনে আরও বেশি উৎসাহী হয়ে উঠবে।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার কৃষক বিপুল মন্ডল জানান, সারা বছরে তিনি ধান বিক্রি করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বেশি পেতেন না। কিন্তু এখন হাই ভ্যালু পণ্য উৎপাদন করে ৩ থেক ৪ বছরে তার বাৎসরিক আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকায়।
তিনি বলেন, "হাই ভ্যালু শস্য উৎপাদনের খরচও বেশি, লাভও বেশি। এর জন্য কৃষকের ঋণের ব্যবস্থা থাকাটা খুবই জরুরি। কারণ টাকা না থাকলে উৎপাদন করা সম্ভব হবে না।"
প্রকল্পের শেষ সময়ে ৬ মাস প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ ফজলুল হক। তিনি বলেন, "আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে পেঁয়ারার বাণিজ্যিক চাষ ও মাল্টা চাষের প্রচারণা শুরু করা হয়েছিল। এখন ব্যপকভাবে এসব ফসলের চাষ হচ্ছে।"
"অফ সিজন সবজির চাষাবাদের নানা প্রযুক্তি আমরা কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। এখন এটার সুফল পাওয়া যাচ্ছে", আরও যোগ করেন তিনি।
পোস্ট হার্ভেস্ট লস কমিয়ে আনতে ফসল তোলার পরবর্তী সময়ে করনীয় হিসেবে বস্তা বাদ দিয়ে ক্যারেটে পরিবহন সহ অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে, কৃষক ও বাজার পর্যন্ত ন্যায দামের বিষয়টাতে খুব বেশি আগানো সম্ভব হয়নি। এই জায়গায় এখনও কাজ করতে হবে বলে জানান তিনি।
দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মোট ২৭টি জেলায় বাস্তবায়িত হয়েছে প্রকল্পটি। মোট ২৭ ধরনের 'হাই ভ্যালু ক্রপস' বা উচ্চফলনশীল শস্য চাষ করা হয়েছে এখানে। এছাড়া, প্রকল্পের আওতায় কৃষকদেরকে উন্নত মানের বীজও সরবরাহ করা হয়েছে।