২৩ দিন ধরে বন্ধ বৈকণ্ঠপুর চা বাগান, দুর্ভোগে ৪৫০ শ্রমিক
এক শ্রমিককের ঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে অপ্রীতিকর ঘটনার পর ২৩ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে হবিগঞ্জের বৈকণ্ঠপুর চা বাগান। এতে চরম দুর্ভোগেহ পড়েছেন এ বাগানের ৪৫০ শ্রমিক। মালিকপক্ষ বাগান বন্ধ করে দেওয়ায় মজুরি-রেশনও বন্ধ রয়েছে তাদের। ২৩ দিন ধরে মজুরি বন্ধ থাকায় অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের এই শ্রমিকদের।
বাগানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এখানকার স্থায়ী শ্রমিক দিলীপ কেউট গত মাসে বাগানের ভেতরের কৃষিজমিতে নিজের জন্য বসতঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কৃষি জমিতে ঘর নির্মাণে আপত্তি জানায় বাগানের মালিকপক্ষ। চলতি মাসে দিলীপ কেউটকে বহিষ্কার করে বাগান কর্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে ৭ ডিসেম্বর বাগানের ব্যবস্থাপকের সাথে বৈঠকে বসে শ্রমিক নেতারা। এই বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে কথাকাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। এ সময় বাগানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়াকে লাঞ্ছিত করে শ্রমিকরা। এ ঘটনায় মোহাম্মদ শামসুল হক ভূঁইয়া বাদী হয়ে ১৪ ডিসেম্বর ১২ শ্রমকিকে আসামি করে মাধবপুর থানায় মামলাও করেন। তবে তার আগেই ৮ ডিসেম্বর থেকে বাগানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় মালিকপক্ষ, যা বন্ধ রয়েছে ৩০ ডিসম্বর পর্যন্ত।
এই বাগানের শ্রমিক মীরা কৈরী বলেন, 'আমরা মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করি। এই টাকায় সংসারই চলে না। ফলে আমাদের তেমন কোনো সঞ্চয় নেই। ২৩ দিন ধরে বাগান বন্ধ থাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।'
যাকে নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত, সেই দিলীপ কেউট বলেন, 'আমি বাগানের স্থায়ী শ্রমিক। ১৫/১৬ বছর ধরে এখানে কাজ করি। কিন্তু বাগানে আমার কোনো ঘর নেই। ভাইয়ের ঘরে থাকি। ছোট ঘরে দুটি পরিবার একসাথে থাকা কষ্টকর। তাই বাগান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে খালি জায়গায় একটি ঘর নির্মাণ করছিলাম। কিন্তু ঘরের কাজ যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন বাগান কর্তৃপক্ষ আপত্তি জানায়। পরে আমাকে বহিষ্কারও করে দেয় তারা।'
উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানে গত সপ্তাহে উভয়পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসেন মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মইনুল ইসলাম। বৈঠকে বাগান চালু করতে মালিকপক্ষ থেকে ৩টি শর্ত দেওয়া হয়। শর্তগুলো হলো—দিলীপ কেউটের বানানো ঘর ভেঙে দিতে হবে, প্রত্যেক স্থায়ী শ্রমিককে ঘর নির্মাণের জন্য ৩ শতক করে জায়গা দেওয়া হবে, বাগান ব্যবস্থাপকের উপর হামলায় জড়িত শ্রমিকদের স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে।
তবে এসব শর্ত মানেনি শ্রমিকরা। ফলে বাগানও চালু হয়নি।
এ ব্যাপারে বৈকণ্ঠপুর চা বাগান আন্দোলন কমিটির সভাপতি মনিব কর্মকার বলেন, '৭ ডিসেম্বর ব্যবস্থাপকের সাথে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তাতে ৭/৮ জন শ্রমিক জড়িত ছিলো। কিন্তু ৭/৮ জনের কারণে বাগান বন্ধ করে সাড়ে ৪ শ শ্রমিক ও তদের পরিবারকে অনিশ্চয়তায় ফেলা অমানবিক। বাগান বন্ধ থাকায় আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি।'
মালিকপক্ষের শর্ত না মানা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'অনেক শ্রমিক পরিবারে ৮/১০ জন সদস্য রয়েছেন। এতসংখ্যক মানুষের জন্য ৩ শতক জায়গার মধ্যে ঘর নির্মাণ সম্ভব না। আর আমরা কোনো শ্রমিকেরই বহিষ্কার চাই না। সবাইকে নিয়েই কাজে যোগ দিতে চাই।'
সৃষ্ট সংকটের বিষয়ে বাগানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক শামসুল হক ভূঁইয়া বলেন, 'দিলীপ কেউট আমাদের অনুমতি না নিয়েই ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করেন। আমরা তাকে কৃষি জমিতে ঘর নির্মাণ না করে বাগানের ভেতরে শ্রমিক বসতি এলাকায় ঘর নির্মাণ করতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি তা না শুনে ঘর নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখেন। এ কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়।'
শামসুল হক ভূঁইয়া বলেন, 'এই ঘটনা নিয়ে আলোচনার কথা বলে শ্রমিকরা আমার কক্ষে এসে হামলা চালায়। এতে আমি ও আরেকজন স্টাফ আহত হই। এরপর আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই বাগানের কার্যক্রম বন্ধ রাখে মালিকপক্ষ।'
তিনি বলেন, 'আমরা বাগান চালু করতে চাই। তবে শ্রমিকদেরও নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে হবে। তাই তাদের তিনটি শর্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা তা মানছে না। ফলে বাগানও চালু করা যাচ্ছে না।'
এদিকে বাগান চালু করা, সব শ্রমকিদের আবাসনের ব্যবস্থা করাসহ ২৫ দফা দাবিতে বুধবার মতবিনিময় সভা ডাকে বৈকণ্ঠপুর চা বাগানের শ্রমিকরা। এতে সঙ্কট নিরসনের জন্য ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয় তারা।
সঙ্কট সমাধানে শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) উভয়পক্ষকে নিয়ে বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রম অধিদপ্তরের শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, 'শুক্রবার আমি উভয়পক্ষকে নিয়ে বসব। আশা করি এতে একটা সমাধানে পৌঁছতে পারব।'