চালের পুষ্টি যাচ্ছে মাছের পেটে, তৈরি হচ্ছে উৎপাদন ঘাটতি
গবেষক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে, সাদা শস্যের জন্য ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং জাতীয় ধান উৎপাদন উভয়ই পড়েছে ক্ষতির মুখে।
চাল পলিশ করে ৮ শতাংশ পর্যন্ত ছাঁটাইয়ের সীমা থাকলেও তা না মেনে বড় বড় চালকল মালিকরা এখন ৩০ শতাংশের বেশি পলিশ করছে। অতিরিক্ত পলিশ করার ফলে চালের যেমন পুষ্টিমান কমছে তেমনি মোট উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। আর পুষ্টিগুণ সম্পন্ন এই চালের ছাঁটাইকৃত অংশ ব্যবহার হচ্ছে মাছ মুরগির খাবার তৈরিতে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও একাধিক গবেষক বলছেন, মাছ, মুরগি ও গরু-ছাগলের খাবার এবং রাইস ব্রান অয়েল তৈরিতে চালের ছাঁটাইকৃত অংশের চাহিদা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে ভোক্তারা চায় সাদা চকচকে চাল।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) ২০১৮ সালে এক গবেষণায় দেখিয়েছে, মিনিকেটসহ পলিশ করা চালে ব্রাউন চালের চেয়ে পুষ্টিগুণ বেশ খানিকটা কমে যায়। কারণ এর ওপরের অংশটি ফেলে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, সাদা চালে প্রোটিনের পরিমাণ লাল চালের তুলনায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। একইভাবে হ্রাস পায় ক্যালরি, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, ফাইবারের পরিমাণ।
বিএফএসএ নতুন করে আরও একটি গবেষণা করছে। পরীক্ষার জন্য ইতোমধ্যে ল্যাবরেটরিতে চাল পাঠানো হয়েছে। এই পরীক্ষা শেষ হলে প্রকৃত চিত্র জানা যাবে।
বিএফএসএ এর সদস্য প্রফেসর ড. মো. আব্দুল আলীম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ল্যাবে চাল পরীক্ষা করতে পাঠানো হয়েছে। ৫, ১০, ১৫, ২০, ৩০ শতাংশ পর্যন্ত চাল ছাটাই করা হলে পুষ্টিমান কী পরিমাণ কমে যায় সেটা এর মধ্যে বের করা হচ্ছে।"
এদিকে যোগান বাড়াতে নিয়ম ভেঙ্গে মিল মালিকরা অতিরিক্ত পরিমাণে চাল ছাটাই করছে। এতে করে ৩০ শতাংশের বেশি পুষ্টিগুণ কমছে। অন্যদিকে চালের মোট উৎপাদন যা হওয়ার কথা তা থেকে ১০ লাখ টনের বেশি চাল কম উৎপাদন হচ্ছে। ফলে নির্ভরতা বাড়ছে আমদানিতে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের করা এক গবেষণায় উঠে এসেছে, এক মণ ধান থেকে সাধারণত ২৭ কেজি চাল পাওয়া যায়। কিন্তু বড় বড় মিলাররা এখন এক মণ ধান থেকে ২৩-২৪ কেজি চাল তৈরি করছেন। বাকি ৩-৪ কেজি রাইস পলিশ হিসেবে ফিড মিলারদের কাছে বিক্রি করছেন। দেশের বড় দুই চালকল মালিক রশিদ ও বেলাল হোসেনের মিলগুলোতে এই অবস্থা খুজে পেয়েছেন গবেষকরা।
দেশের লাইভস্টক সেক্টরের ফিড প্রস্তুতকাররা বলেন, ফিড তৈরির নানা উপাদানের মধ্যে ১০ শতাংশ।
পর্যন্ত পলিশ রাইস ব্যবহার করা হচ্ছে। বছরে ফিড উৎপাদন হয় ৬৫ লাখ টনের বেশি। সে হিসেবে ফিড ইন্ডাষ্ট্রিতে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন রাইস পলিশ ব্যবহার হয়। যা ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে মিলাররা বিক্রি করে।
তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রাইস ব্রানসহ বিভিন্ন সেক্টরে পলিশ রাইস ব্যবহারের পরিমাণ গত কয়েক বছরে বেশ বেড়েছে। এর পরিমাণ ১০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে রাইস পলিশ উৎপাদন করায় চালের মোট সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। আবার চাল থেকে যে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়ার কথা সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিড মিল অ্যাসোসিয়েশনের (এফআইএবি) সভাপতি ইহতেশাম বি. শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, "ফিডের একটি বড় ইনগ্রেডিয়েন্ট রাইস পলিশ। ফিডে ১০ শতাংশের মত এটি ব্যবহার হয়, যা আমরা রাইসমিলগুলো থেকেই পাই।"
স্বয়ংসম্পূর্ণতা দাবির বিপরীতে রয়েছে ঘাটতি, দামও ঊর্ধ্বমুখী
বছর দুয়েক ধরে চালের দামে লাগাম টানতে না পেরে সরকার আমদানির উপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। ১৭ লাখ মে. টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে শুধু বেসরকারি খাতেই।
সরকারিভাবেও চাল আমদানি করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসেব কষে বলছে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে।
কিন্তু এই পরিমাণ চাল উৎপাদিত হলে নতুন করে আমদানির প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়।
মিনিকেট চাল নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই বেশ আলোচনা চলছে। মিনিকেট নামে ধানের জাত না থাকলেও প্রশ্ন উঠেছে কিভাবে আসছে এই চাল। সাধারণত বিআর-২৮, ও বিআর-২৯ জাতের ধান থেকেই তৈরি হচ্ছে এই চাল।
গবেষণায় দেখা গেছে, মিনিকেট বা নাজিরশাইল হলো চালের দুটি ব্র্যান্ড। বি-আর ২৮, বি-আর ২৯ জাতের ধান একই মিলে প্রসেস করা হয়। শুধু চালটা বের হওয়ার পর ব্র্যান্ডগুলোর আলাদা, আলাদা বস্তায় ভরে বাজারজাত করা হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, "মিলারদের ৮ শতাংশের বেশি চাল ছাটাইয়ের নিয়ম নেই। কিন্তু তারা সেটা ৩০ শতাংশ এবং ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি পরিমাণে করছে। তবে এর প্রভাবে পুষ্টি বা সরবরাহ ঘাটতি ঠিক কি পরিমাণে হচ্ছে তা আমরা বের করতে গবেষণা চালিয়ে যচ্ছি।"
একই সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয় বের করার চেষ্টা করছে পলিশ চাল ঠিক কতটা ব্যবহার হচ্ছে বিভিন্ন ইন্ডাষ্ট্রিতে। পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষ হলে ভোক্তাদের মধ্যে প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি মিলারদের
উপরও কড়াকড়ি আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
চালের বস্তায় ধানের জাতের নাম উল্লেখের বাধ্যবাধকতা কথা খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানালেও এটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বিএফএসএ এর গবেষণাটি শেষ হওয়ার পর। এর পর থেকে হয়তো চালের বস্তায় ধানের জাতের নাম উল্লেখ বাধ্যতামূলক করা হবে।
তবে মিলাররা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি জাতের ধান দিয়ে আলাদা করে চাল তৈরিতে জটিলতা রয়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে নানা জাতের ধান একসঙ্গে কিনতে হয় মিলারদের।
অন্যদিকে আধুনিক অটো রাইস মিলগুলোর সক্ষমতাও অনেক বেশি। মাঝারি মানের একটি মিলেই প্রতিদিন দুই-তিন হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। যেখানে ছোট পরিমাণে আলাদা আলাদা জাতের চাল তৈরির সুযোগ সীমিত।
এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় বলছে, যদি দুটি বা তিনটি জাতের ধানের মিশ্রনে চাল তৈরি করা হয়, সেক্ষেত্রে সবগুলো জাতের ধানের নামই উল্লেখ করতে হবে। তবে এখানে মিনিকেট বা নাজির ব্র্যান্ড নামগুলো ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হতে পারে।
বগুড়ার রাইস মিল নাহিদ এন্ড ব্রাদার্স এগ্রো ফুড ইন্ডাষ্ট্রিজ এর সত্তাধিকারি মো. আহম্মদ আলী সরদার টিবিএসকে বলেন, "রাইস পলিশ সাধারণত মাছ, মুরগির খাবার তৈরি এবং রাইস ব্রান ওয়েল তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।"
বাংলাদেশ অটো রাইস এন্ড হাস্কিং মিল মালিকদের সংগঠনের সাধারন সম্পাদক মো. লায়েক আলী বলেন, "সরকার গবেষণা করছে। যে সিদ্ধান্ত দিবে সেটাই আমরা পালন করবো।"