নৌ-দুর্ঘটনা: বাতিল অধ্যাদেশে বিচার, দ্রুত সংশোধনের দাবি
১৯৭৬ সালে সামরিক শাসনামলে প্রণীত অভ্যন্তরীণ 'নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ' সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু এখনো নৌযান দুর্ঘটনার মামলার বিচার হচ্ছে এই বাতিল অধ্যাদেশ দিয়ে।
অধ্যাদেশটি একদিকে বাতিল, অপরদিকে সময়োপযোগী নয়। ফলে এই আইনে মামলা করে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই অধ্যাদেশটি বতিল করে যুগোপযোগী একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়াও ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনার দায়ে চালকের শাস্তি কমিয়ে যে বিধান করা হয়েছে, সেটিও বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন তারা। আইনটিতে ভিকটিম ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য যে 'আর্থিক সহায়তা তহবিল' গঠনের কথা বলা হয়েছে, সেটিও দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
একইসাথে নৌপথ, সড়কপথ ও আকাশপথে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত 'নৌপথে ও সড়কপথে অবহেলাজনিত মৃত্যু: যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও দায়বদ্ধতা' শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা।
ব্লাস্টের অনারারি নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, 'সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে সামরিক আইনের সকল আইন ও অধ্যাদেশ বাতিলের আদেশ দিয়েছেন। ওই আইনগুলো সংশোধনের নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। এরপরেও অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ-১৯৭৬ অনুযায়ী নৌ দুর্ঘটনার বিচার হওয়া সংবিধানের পরিপন্থী। তাই অধ্যাদেশটি বাতিল করে নতুন আইন করা জরুরি।'
এছাড়াও ওই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, নৌ দুর্ঘটনার ভিকটিমের জন্য যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা নামেমাত্র।
তিনি বলেন, 'সড়ক পরিবহন আইন-১৯৮২ অনুযায়ী, দুর্ঘটনার জন্য মৃত্যু হলে 'অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায়ে' শাস্তির বিধান ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে নতুন আইন প্রণয়ন করে মাত্র ৫ বছরের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। যা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।'
সারা হোসেন বলেন, 'চালকদের শুধু শাস্তির আওতায় আনলে চলবে না। যারা মালিক বা কর্তৃপক্ষ তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা সময়ের দাবি।'
ব্লাস্টের প্যানেল আইনজীবী জীবনানন্দ জয়ন্ত বলেন, '২০০৩ সালের জুলাই মাসে মেঘনার ডাকাতিয়ায় এমভি নাসরিন ডুবে যাওয়ার ঘটনায় প্রায় ৬৫০ জন নিহত ও কয়েকশত মানুষ নিখোঁজ হয়। আহত হয় কয়েকশত। এই ঘটনায় ২০০৪ সালে মামলা হলেও প্রায় দেড় যুগে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।'
তিনি বলেন, 'নৌ-দুর্ঘটনার প্রতিটি মামলা এরকম বছরের পর ঝুলে থাকে। এ বিষয়ে আদালতকেও উদ্যোগ নিতে হবে।'
এছাড়াও নৌ-দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করলে অধিক পরিমাণ কোর্ট ফি দিতে হয়। ফলে বেশিরভাগ ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবার মামলা করতে চায় না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'এসব দুর্ঘটনার পিছনে মূলত দায়ী 'রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছা' না থাকা।'
তিনি বলেন, 'সড়ক ও নৌপথে দুর্ঘটনা রোধে কঠোর আইন করলেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য কিছু নির্দিষ্ট পরিবহন নেতা, চাপের মুখে সরকারকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করে। এই কালচার থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে। নইলে নৌ ও সড়ক পথে কোনোভাবেই দুর্ঘনা কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।'
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার অনীক আর হক বলেন, 'একটি লঞ্চ বা জাহাজ স্টেশন থেকে ছাড়ার আগে বিআইডব্লিউটির একজন কর্মকর্তা লঞ্চটির ফিটনেস ও যাত্রী ধারণ ক্ষমতা পরিদর্শন করে রিপোর্ট দেন।
কিন্তু ঘুষের বিনিময়ে তারা প্রায়ই অধিক যাত্রী নেওয়া ও জাহাজের ফিটনেস পরীক্ষা করে দেখেন না। এসব কর্মকর্তাসহ বিআইডব্লিউটিএর দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।'
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম। আলোচনায় আরও অংশ নেন 'নিরাপদ সড়ক চাই' (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন।