ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণের হিড়িক—রিয়েল এস্টেটে নতুন হাওয়া
বিশাল জমির প্লটের ওপর একইরকম দেখতে সারি সারি দ্বিতল বাড়ি। প্রতিটা বাড়িতে পর্যাপ্ত জায়গা আছে। সামনে সুন্দর সুন্দর বাগান। এই ডুপ্লেক্স ভবনগুলো নগরের আকাশছোঁয়া অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের একেবারেই উল্টো।
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের উত্তর-পূর্ব দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর কাছেই এই বিশাল রিয়েল এস্টেট প্রকল্প।
সম্প্রতি খোলামেলা ও আরামদায়ক বাড়ির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে ধনী ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের। তাদেরকে লক্ষ্য করেই এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে এশিয়ান ডুপ্লেক্স টাউন।
২০১৬ সালে ৩০০ বিঘা জমির ওপর জমির ওপর প্রায় ৭০০টি বাড়ি নির্মাণের এই প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পটির প্রায় সবগুলো প্লটই ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন এশিয়ান টাউন ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের এক কর্মকর্তা।
ডুপ্লেক্স বাড়ির চাহিদা এত দ্রুত এভাবে বাড়তে দেখে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোও দেশজুড়ে বিপুল বিনিয়োগ করছে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর তথ্যানুসারে, পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভারসহ রাজধানীর পাশ্ববর্তী এলাকাগুলোতে গত দশ বছরে প্রায় ১০০টি ডুপ্লেক্স আবাসিক প্রকল্প গড়ে তুলেছে বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান।
এসব প্রকল্পের মধ্যে প্রায় ৩০টি গড়ে উঠছে কেরানীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে এলাকায়। এছাড়াও কেরানীগঞ্জের ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের আশপাশে ৬টি ডুপ্লেক্স বাড়ির প্রকল্প গড়ে উঠেছে।
রিহ্যাব জানিয়েছে, সিলেট বিভাগে শহরকেন্দ্রিক ২৫টি প্রকল্প, চট্টগ্রামে ১৮টি, কক্সবাজারে ৬টি এবং বগুড়ায় বেশ কয়েকটি ডুপ্লেক্স বাড়ির প্রকল্প চলমান রয়েছে।
রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর সামসুল আলামীন কাজল টিবিএসকে বলেন, ২০২১ সালে আবাসন খাতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ির জন্য।
এশিয়ান ডুপ্লেক্স টাউনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই প্রকল্পের ১১০টি বাড়ির নির্মাণকাজ শেষ। বিক্রিত প্লটের ওপর ২০২৪ সাল নাগাদ সব বাড়ি নির্মাণ সম্পন্ন করে গ্রাহকদের কাছে হস্তান্তর করা যাবে বলে তারা আশাবাদী।
দশ কাঠা প্লটের ওপর নির্মিত দুইতলা বাড়ির নিচতলায় থাকবে একটি ড্রয়িং রুম, রিফ্রেশমেন্টর জায়গা ও মিটিং রুম। ওপরতলায় থাকবে ৫টি বেডরুম ও ৪টি বাথরুম। আর বাড়ির চারপাশেই থাকবে একটি বড় পরিসরের ব্যালকনি। এছারাও ভবনের সামনে থাকবে বাগান, শিশুদের খেলার জায়গা ও পার্কিং স্পেস।
৫ কাঠা ও ৩ কাঠা প্লটের ওপর তিনটি করে বেডরুম থাকবে বলে জানা ওই কর্মকর্তা।
প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয় বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, ১০ কাঠা প্লটের ওপর বাড়ির বিক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এরকম ৮০টি বাড়ি হবে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে বাড়িসহ ৫ কাঠার প্লটের দাম পড়বে সাড়ে ৪ কোটি টাকা। এরকম প্লট রয়েছে ৩০০টি।
আর বাড়িসহ ৩ কাঠার প্লটের দাম ৩ কোটি টাকা। এরকম প্লট রয়েছে প্রায় ৩০০টি।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে তারা বাড়ির ডিজাইনসহ এসব প্লট বিক্রি করেছেন। ক্রেতারা প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বাড়িসহ প্লট কিনেছেন।
এশিয়ান টাউন ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিলাস দাস টিবিএসকে বলেন, এই প্রকল্পের বেশিরভাগ ক্রেতা প্রবাসী ও ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, 'ঢাকার কাছে, নিরিবিলি ও স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের উপযোগী এবং যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ক্রেতারা আকৃষ্ট হয়েছে এই প্রকল্পে বাড়িসহ জমি কেনার জন্য।'
এই প্রকল্পে বাড়িসহ দশ কাঠা প্লট কিনেছেন সুইজ্যারল্যান্ড প্রবাসী ইকরামুল হক টুটুল।
তিনি টিবিএসকে বলেন, বেশিরভাগ সময়ই তাকে পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকতে হয়। 'রাজধানীর বাড্ডায় একটি পৈত্রিক বাড়ি আছে। যেখানে বাবা-মা থাকেন। কিন্তু রাজধানীর মধ্যে এখন স্বচ্ছন্দে বসবাস বেশ কঠিন। তাই বাবা-মার থাকার জন্য এবং দেশে অবস্থানকালে সেখানে থাকার জন্য এই প্রকল্পে বাড়ি কেনা।
'এছাড়াও এই প্রকল্পে সবগুলো বাড়ি একই ডিজাইনের হচ্ছে। এবং বাড়িও নির্মাণ করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে আমার ওপর কোনো বাড়তি ঝামেলা আসেনি।'
কোন বছর কত বিনিয়োগ
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অভ প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর তথ্যমতে, গত দশ বছরে বিভিন্ন ডুপ্লেক্স বাড়ির প্রকল্পে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে সবেচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে।
বিআইপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে জানান, প্রতি বছর ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ ও বিভিন্ন প্রকল্প বাড়ছে।
সংগঠনটির একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারা দেশে ডুপ্লেক্স বাড়ির প্রকল্পে ২০২০ সালে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা, ২০১৯ সালে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, ২০১৮ সালে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, ২০১৭ সালে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা, ২০১৬ সালে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, ২০১৫ সালে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা, ২০১৪ সালে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা, ২০১৩ সালে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা এবং ২০১২ সালে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।
সিলেটের আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন সিলেট অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট গ্রুপ (সারেগ)-এর সভাপতি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল টিবিএসকে বলেন, 'সিলেটে প্রায় ১০০টি আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।'
প্রতি বছর সিলেট বিভাগে আবাসন খাতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয় বলে জানান তিনি। এর মধ্যে ডুপ্লেক্স বাড়ির প্রকল্পে বিনিয়োগ হয় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
নাদেল আরও জানান, সিলেটের আাসন খাতে প্রবাসীদের বিনিয়োগ প্রায় ৯০ ভাগ। তার ধারাবাহিকতায় ডুপ্লেক্স বাড়ির জন্য বিনিয়োগের ৯০ ভাগও প্রবাসীদের।
বিলাসিতার খোঁজে ধনীরা
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, দেশের বেশিরভাগ টাকা এখন ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর মানুষের কবজায়।
এই মানুষগুলো সবসময় সবকিছুতেই বেশি বিলাসিতা খোঁজে। বিশেষ করে নিজের থাকার জায়গাটা যত বেশি স্বচ্ছন্দ করা যায়, সেদিকে বেশি খেয়াল রাখে তারা।
ইকবাল হাবীব বলেন, 'টাকা তো খরচ করতে হবে বা কাজে লাগাতে হবে। দেখা যায় ডুপ্লেক্স আবাসন প্রকল্পে যারা বাড়ি কেনেন, তাদের বেশরিভাগেরই রাজধানীতে একাধিক বাড়ি রয়েছে।
এছাড়াও এসব ডুপ্লেক্স প্রকল্পে ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স নিশ্চিত ও খোলামেলা পরিবেশ থাকায় বিনিয়োগ বাড়ছে।'
কিন্তু এভাবে ডুপ্লেক্স প্রকল্প বাড়লে সাধারণ মানুষের আবাসন সংকট কাটানো সম্ভব নয় বলে সতর্ক করেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।
তবে অর্থনীতিবীদ আহসান এইচ মুনসুর বলেন, পুঁজিবাজার ও ও আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। 'এই দুই খাতে কালো টাকা বিনিয়োগ করলে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এই টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না।'
গত বছর প্রায় সাড়ে আবাসন খাতে ৩ হাজার কোটি কালো টাকা বিনিয়োগ হয়েছে বলে জানান তিনি।
আহসান এইচ মুনসুর বলেন, 'রাজধানীতে সেভাবে জমি বা ভবন কেনার সুযোগ অনেকটাই কমে এসেছে। ফলে দেখা যায় একটু বেশি টাকা বিনিয়োগ করে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি কেনা বা এরকম আবাসন ব্যবসা অনেকেই পছন্দ করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ডুপ্লেক্স বাড়ির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।'
রাজধানীতেও বাড়ছে ডুপ্লেক্স বাড়ি
শুধু রাজধানীর পাশ্ববর্তী এলাকায় নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে, গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি ও উত্তরা এলাকায়ও ডুপ্লেক্স বাড়ি বানানোর প্রবণতা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াজ (বিটিআই), নাভান রিয়েল এস্টেট, অ্যাসিউর গ্রুপ, রুপায়ন গ্রুপ, আর্টিসান গ্রুপ, এবিসি রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, ডোম-ইনো, আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক, শান্তা হোল্ডিংস লিমিটেড, র্যাংগস প্রপার্টিস লিমিটেড, সাউথ ব্রিজ হাইজিং লিমিটেডসহ আবাসন খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো এসব বাড়ি নির্মাণের কাজ করছে।
র্যাংগস প্রপার্টিস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার ও হেড অফ সেলস অমলেন্দু বিশ্বাস টিবিএসকে জানান, র্যাংগস গুলশানে কয়েক বছরে ৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। গুলশান ১ এলাকায় র্যাংগস ওয়াটারফ্রন্ট কনডোমিনিয়াম নির্মাণ করেছে প্রায় ৩ বিঘা জমির ওপর। সেখানে ৮ তলাবিশিষ্ট পৃথক ৫টি ভবনে দুইতলা করে ডুপ্লেক্স হোম বানানো হয়েছে।
তিনি জানান, গুলশান ২-এ দুই বিঘা জমির ওপর আরেকটি কনডোমিনিয়াম নির্মাণাধীন রয়েছে। সেখানেও প্রতিটি ইউনিট হবে ডুপ্লেক্স।
গুলশান, বনানী ও বারিধারায় তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে সাউথ ব্রিজ হাউজিং লিমিটেড। এর আগে আরও ৪টি ডুপ্লেক্স কনডোমিনিয়াম বাস্তবায়ন করেছে বলে জানান কোম্পানিটির একজন কর্মকর্তা।
কী বলছে রাজউক
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী টিবিএসকে বলেন, দেশে ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণের প্রকল্প শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে। এরপর ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০টির মতো আবাসন প্রতিষ্ঠান ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণের অনুমতি নিয়েছে রাজউক থেকে।
তবে সাধারণ মানুষের সহজলভ্য আবাসন গড়ে তুলতে রাজউক এখন অনেক চিন্তা-ভাবনা করে এরকম প্রকল্পের অনুমোদন দেয় বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, '২০২০ ও ২০২১ সালে ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণের কোনো প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি রাজউক।'